প্রবন্ধ ১...
যার পরে বোধন নেই

বিসর্জন মানেই তো শেষ হয়ে যাওয়া। আমাদের ছোটবেলায়, মানে প্রায় আড়াই দশক আগের কলকাতা সংলগ্ন আধা মফস্সল পাড়ায় যখন প্রতিমা নিরঞ্জন শেষে পুকুরের জল আঁজলা ভরে জল ছিটিয়ে দিত বড়রা, সেই জলের ফোঁটায় বিষাদ লগ্ন হয়ে থাকত। তখন দশমীর দিনই ভাসান হত। ফেরার পথে মন্দিরের মাঠের খাঁ খাঁ মণ্ডপের দিকে তাকালে মনখারাপ বাঁধা। আলো-ঝলমল ভাল লাগার দিন শেষ হয়ে যাওয়ার মনখারাপ। বিসর্জন মানেই ছিল শেষ হয়ে যাওয়া।
অথবা, বিসর্জনই একমাত্র, যেখানে এই শেষ আর এক শুরুর জন্মমুহূর্ত। যেখানে ভাসানের পরের দিনই কালোকুলো দেখতে ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে পুকুরে, আঁকশি দিয়ে টেনে আনবে কাঠামো। সেই কাঠামোর ওপর পরের বার ফের মাটি চাপবে, ফের প্রতিমা তৈরি হবে, ফের কুমোরটুলি থেকে ম্যাটাডোরে চাপিয়ে সেই প্রতিমা নিয়ে আসা হবে মণ্ডপে। পুজোই একমাত্র, যেখানে শেষ হওয়ার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা থাকে পরের বারের সূচনা। দশমীর মনখারাপও, তাই, খানিক সুখের মতো ব্যথা। যা হারিয়ে গেল, তা ফিরে পাওয়া যেখানে অনিবার্য বালিশের পাশে নতুন জুতো রেখে ঘুমিয়ে পড়ার মতোই, শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা।
বাকি বিচ্ছেদগুলো নির্মম। সেখানে শেষ হয়ে যাওয়া মানে শেষ। নতুন কুসুম ফোটে বটে, কিন্তু যে কুসুম ‘ঝরিয়া পড়ে’, সে চিরতরেই যায়। আমাদের সেই আধা মফস্সল পাড়ায় আমাদের একটা বাড়ি ছিল। পুরনো, খানিক ভাঙাচোরা, ছোট। যখন পুরনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট বানানো আরম্ভ হল, আমাদের বাড়িটাও দিয়ে দেওয়া হল। তার বদলে যে ফ্ল্যাট পেলাম, সেটা সব দিক থেকেই ভাল। আলোবাতাস ঢোকে, কল খুললেই চব্বিশ ঘণ্টা জল পাওয়া যায়, বর্ষার জলে ঘর ভেসে যায় না। শুধু, আমার বাড়ির পাঁচিল ঘেঁসে যে বিরাট কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল, সেটা থাকল না। বসন্ত, গ্রীষ্মে একেবারে লাল হয়ে থাকত গাছটা। কৃষ্ণচূড়ার বীজ থাকে যে খোলসের ভিতর, সেটা আমার, আমাদের শৈশবের খেলায় তরোয়াল হত, সেগুলো থাকল না। সে কত বছর আগের কথা দু’জন আধচেনা লোক এসে কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে কেটে ফেলল সেই সুবিশাল কৃষ্ণচূড়ার গাছকে। সারা দিন ধরে কেঁদেছিলাম বালক আমি। তখন বুঝেছিলাম কি না সে আমার মনে নেই, কিন্তু এখন বুঝি এই বিচ্ছেদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, কোনও পুনর্মিলনের সম্ভাবনা নেই। জনমের মতো, হায়, হয়ে গেল হারা। কোনও বিসর্জন কখনও এ বিষাদের গভীরতা স্পর্শ করতে পারে না।
জানি না, এই বিষাদের গল্প হয়তো আমার পূর্বপুরুষরা জানতেন। তাঁরা ফেলে এসেছিলেন তাঁদের বাড়ি, পুকুর, বাগান, সবই। সেই অলীক বিশ্বাসে যে এই দেশভাগ কখনও পাকাপাকি হতে পারে না। কলকাতার বাসা থেকে তাঁরা ফের শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে ফিরতে পারবেন ঢাকায়, ফরিদপুরে। সেই বিশ্বাস কখন ভেঙে গিয়েছিল, কখন তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন যে কলকাতার উপকণ্ঠের এই রিফিউজি কলোনিই তাঁদের এ জীবনের একমাত্র পাকাপাকি ঠিকানা, জানতে চাইলে তাঁরা সম্ভবত বলতে পারতেন না। তবু, মাদারিপুর সাবডিভিশনের কথা বলতে গিয়ে, বাগানের জম্বুরা পেড়ে তা দিয়ে ফুটবল খেলার কথা বলতে গিয়ে, স্কুলের কথা বলতে গিয়ে তাঁদের চোখ যে ভাবে জ্বলে উঠে ফের হারিয়ে যেত, তাতে মনে হওয়া বিচিত্র নয় যে এই বিচ্ছেদ শুধু ঘরবাড়িস্কুলমাঠের সঙ্গে নয়, নিজের শৈশবের সঙ্গে, কৈশোরের সঙ্গে, নিজের অত্যাগসহন সত্তার সঙ্গে বিচ্ছেদ। নিজের অতীতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংযোগহীন হয়ে যাওয়ার বিচ্ছেদ। আর যে কখনও আমি কোনও গ্রীষ্মের কোনও কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকাতে পারি না সুতীব্র বিষাদের অনুভূতি ছাড়া, তা-ও সেই অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আজন্ম কষ্টের কারণেই নয়?
অবশ্য, শুধু সেই কৃষ্ণচূড়াই নয়, শুধু সেই ছোট, আলো-না-ঢোকা বাড়ির চিলেকোঠা, বা ছোট ঘরের জানালা দিয়ে বিছানায় এসে পড়া একচিলতে রোদ্দুরই নয়, আর এক অমিলনসম্ভব বিচ্ছেদ বহন করে চলি আমি। আমার জীবনের প্রথম সব কিছু জানত সে। আজ থেকে দশ বছর আগে পর্যন্ত। ২০০৩ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। আমার চেয়ে এক বছরের ছোট ভাই পিসতুতো ভাই, কিন্তু সে কথা দু’জনের কেউই মনে রাখিনি কখনও রন্টি। বাইক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর খবর যখন পেলাম, রাত্রি বারোটার পরে, আমি তখন দিল্লিতে। সেই মুহূর্তে, তার পরের কয়েকটা দিন যে যন্ত্রণা ছিল, তা অবশ করা। তার পর, যে ভাবে সব শোকই তীব্রতা হারায়, সে ভাবেই থিতিয়ে এসেছিল বিচ্ছেদযন্ত্রণা।
কিন্তু, ক্রমে খেয়াল করে দেখলাম, একা যে রন্টিই নেই, তা তো নয়। আমার প্রথম তেইশটা বছরও তো নেই। একেবারে নেই। যত দিন সে ছিল, তত দিন দু’জনের কেউই খেয়াল করে দেখিনি, অতীত যে সিন্দুকে জমা থাকে, তার চাবি আসলে দুটো, দু’জনের স্মৃতিতে। একটা না থাকলে অন্যটাও নিতান্ত অচল। অতএব, যে সব কথা জনসমক্ষে বলা যায় আর যা বলা যায় না, তার সমস্তটাই আমার স্মৃতিতে নিখুঁত ধরা থাকলেও তা অগম্য পূর্ববঙ্গের ফেলে আসা ঠাকুরদালানের মতোই। অথবা কোনও স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষের মনের মতো। হয়তো সেখানেও ছেঁড়া ছেঁড়া ফিরে আসে অতীত। কিন্তু তাকে ধরার আগে, একটার সঙ্গে অন্যটাকে গেঁথে ফেলে একটা যুক্তিগ্রাহ্য আখ্যান নির্মাণ করার আগেই আবার তা হারিয়ে যায়। পড়ে থাকে বিস্মৃতির বর্তমান। এই বিচ্ছেদ আসলে অলঙ্ঘ্য পার্টিশন।
এই অলঙ্ঘ্য বিচ্ছেদের গল্প আমার একার জীবনের নয়। হয়তো প্রত্যেকেরই, হয়তো কারও কারও। কিন্তু, প্রত্যেকের একা। একই বিষাদে, পাশাপাশি থাকা দুটো মানুষ, একা একা বিষণ্ণ থাকেন। কার মনের তন্ত্রীতে যে কী সুরে বাজে সেই বিষাদ, একেবারে পাশের মানুষটিরও কখনও পুরোটা জানা হয়ে ওঠে না। বিসর্জনের বিষাদ সেখানে সমষ্টির। সমষ্টির বলেই, তাকে ভাগ করে নেওয়া যায়, শূন্য মণ্ডপে ফিরে এসে মিষ্টিমুখ সেরে বলা যায়, আসছে বছর আবার হবে।
যারা জানে, আর কখনও হবে না, কোনও দিনও নয়, তাদের কিছু বলার থাকে না। এক, বা একাধিক, অমোঘ বিসর্জন তাঁরা বহন করে চলবেন। আজীবন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.