সম্পাদকীয়...
নীতির গতি
ফিনল্যান্ডে এক গাড়ি-চালক গতিসীমা অতিক্রম করিয়া গাড়ি চালাইলেন বলিয়া তাঁহার জরিমানা হইল এক লক্ষ তিরিশ হাজার ডলার! এই বিপুল জরিমানার কারণটিও আশ্চর্য: ওই চালক কোটিপতি। ফিনল্যান্ডের নিয়ম, ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘন করিলে জরিমানার পরিমাণ নির্ভর করিবে চালকের সম্পত্তির উপর। যদি চালক গরিব হন, জরিমানা হইবে কম, যদি ধনী হন, জরিমানা হইবে অধিক। নিয়মটি আপাত ভাবে সাম্যের জয়ধ্বজা উড়াইলেও, উহার মধ্যে আশ্চর্য সাম্প্রদায়িকতা নিহিত। ধনীর ধন জুলুম করিয়া কাড়িয়া তাহা গরিবকে বিলাইয়া সমাজের হিতসাধনের রবিনহুডীয় তত্ত্ব রূপকথাবিলাসী মানুষের প্রিয় হইতে পারে, কিন্তু তাহা দেশের আইন প্রণয়নের কালে নীতিভ্রষ্ট হইবার যথেষ্ট অজুহাত নহে। এইখানে কর আদায় হইতেছে না, জরিমানা আদায় হইতেছে। অপরাধীর ব্যাংকের ভল্টে কতগুলি সোনার বাট রাখা রহিয়াছে, তাহার উপর ঘণ্টায় সাতাত্তর কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাইবার মাসুল নির্ভর করিবে কোন যুক্তিতে? ঠিক তাহার পিছনের গাড়িটি হুবহু একই অপরাধ করিলে, আর সেই গাড়ির চালক অতিশয় দরিদ্র হইলে, তাহার জরিমানা হইবে অতি ন্যূন? এক অপরাধের পৃথক শাস্তি হইলে, তাহা স্পষ্টই বৈষম্যকে লালন করে। ট্রাফিক-অনুশাসনের ক্ষেত্রে ধনী ব্যক্তির দায়িত্ববোধ দরিদ্র ব্যক্তির দায়িত্ববোধের তুলনায় বহু গুণ অধিক হইতেই হইবে, এই দাবিও উদ্ভট। অপরাধীদের সম্পত্তির পরিমাণে বৈষম্য আছে বলিয়া তাহাদের প্রতি আইন বৈষম্যমূলক আচরণ করিলে, আইনের অপরাধ প্রকাণ্ড। আইনের দেবীর চক্ষু পট্টিবদ্ধ রহিয়াছে, তাঁহাকে অন্ধ ও যথেচ্ছাচারী করিবার জন্য নহে, তাঁহাকে পক্ষপাতশূন্য করিবার জন্য। একটি রাষ্ট্র যদি গরিবদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, তাহা যেমন অশ্লীল ঘটনা, একটি রাষ্ট্র যদি ধনীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, তাহা সমান অশ্লীল ঘটনা।
সমাজে কয়েকটি মাত্র মানুষ অনেক পরিমাণ সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করিবে ও বহু মানুষ তাহার অর্ধেকের অর্ধেকও পাইবে না, তাহা নিঃসন্দেহে আদর্শ পরিস্থিতি নহে। তাহাতে ধনীদের প্রতি অধিকাংশ মানুষের আক্রোশও স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভিত্তিতে প্রশাসন যদি ‘মারি ধনী পারি যে কৌশলে’ প্রক্রিয়ায় নিজ শস্ত্র সাজায়, তবে সেই রাষ্ট্র সাম্য ভজিতে গিয়া অসাম্যেরই আরাধনা করিল। আসলে, অধিকাংশ সময়, বাস্তবে বা শিল্প-উপভোগের কালে, আমাদের আবেগ ও সংগ্রামচেতনা সারি দিয়া দাঁড়ায় পরাজিত মানুষের পক্ষে। সেই সঙ্গত কর্মটি করিতে করিতে এমন অভ্যাস হইয়া যায় যে, বস্তুগত ভাবে পরাজিত নহে এমন মানুষও যে অন্যায়ের শিকার হইতে পারে, চট করিয়া মস্তিষ্কে বিম্বিত হয় না। এমন ভাবে দরিদ্রের সহিত নিগৃহীত, কোটিপতির সহিত শোষক, ধনীর অর্থক্ষতির সহিত ‘বেশ হইয়াছে’ মার্কা ন্যায়সাধনের ধারণা আমাদের মানসে ওতপ্রোত হইয়া গিয়াছে, নির্দিষ্ট ঘটনায় কখন ধনীই বলি হইতেছে, তাহা নজর করা কঠিন হইয়া উঠে, সুনীতির পক্ষে সওয়াল করিতে হৃদয় সরে না। ইহা দুর্ভাগ্যজনক: পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ রূপে গুণে সম্পদে হীন। ইহা আরও দুর্ভাগ্যজনক: রূপবান গুণবান সম্পদবান মানুষের প্রতি সেই বঞ্চিত মানুষদের সামগ্রিক ঈর্ষাকে, পরশ্রীকাতরতাকে স্বতঃই ন্যায্য হিসাবে ভাবিয়া লওয়া হয়। কঠোর অভিনিবেশের সহিত বিচার না করিয়াই, এই সহজ ও বহুজনতোষী সমীকরণে বিশ্বাস করা হয়: ধনীর কষ্ট হইলে তাহা দরিদ্রের সুখ হইবার মতোই কাঙ্ক্ষণীয় ঘটনা। অথচ নীতির প্রধান শর্তই হইল, তাহাকে পূর্ব-সংস্কার বর্জিত হইতে হইবে। জনমানসে বেচারি ধনী বিচারের পূর্বেই দণ্ডিত হইয়া আছে। কত সহজে আমরা ধরিয়া লই: অশেষ টাকা যাহার রহিয়াছে, সে অবশ্যই দুর্নীতিগ্রস্ত, অমানুষ। এই অন্যায় ধারণার শকটটি চলিতেছে প্রতিশোধস্পৃহার বাষ্পে। তাহা নীতিসীমা অতিক্রম করিলেও তাহার জরিমানা ঘটে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.