তসরগুটি চাষে আদিবাসীদের উত্‌সাহ দিতে শুরু নতুন প্রকল্প
শ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচ রাজ্যের মাওবাদী প্রভাবিত একাধিক জেলায় বছরের পর বছর পড়ে থাকা অনুর্বর জমিতে তসর সিল্কের কোকুন বা গুটি চাষে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রাথমিক ভাবে বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুর ১, বিনপুর ২ ও নয়াগ্রাম ব্লক ছাড়াও ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে ওই প্রকল্প হবে। তসরের উত্‌পাদন থেকে বিপণন প্রতিটি ধাপে পেশাদারিত্ব আনতে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে সম্প্রতি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
যে ব্লকগুলিকে তসরের গুটি চাষের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে, সেগুলি মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত। সরকারের আশা, পিছিয়ে পড়া ওই সব এলাকায় ৫০ কোটি টাকার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে পাঁচ রাজ্যের অন্তত ১৮ হাজার পরিবার উপকৃত হবে। ‘ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড্‌স মিশন’ প্রকল্পের আওতায় আগামী তিন বছরে ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝাড়খণ্ড, বিহারের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় সাফল্যের সঙ্গে নানা উন্নয়নমূলক কাজ করছে ওই সংস্থা। কেন্দ্রীয় সরকার ওই সংস্থার অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে তসর-গুটির চাষ করতে চাইছে।
‘প্রদান’ নামে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক কর্তা অর্ণব চক্রবর্তী বলেন, “প্রকল্পটি ঠিক মতো রূপায়িত করা গেলে ওই সব এলাকায় গরিব তসর চাষি ও শিল্পীদের মহাজন-নির্ভরতা অনেকটাই কমে যাবে।” রানিবাঁধ, রায়পুর এবং বিনপুর ২ হল চিরাচরিত ‘তসর এলাকা।’ তসর-গুটি চাষের সঙ্গে যুক্ত চাষিরা জানিয়েছেন, ২০০ টাকায় এক গ্রাম ডিম কিনতে হয় মহাজনদের কাছ থেকে। তার পর তা অর্জুন গাছে ছেড়ে দিলে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে পোকা ও পরে ধীরে ধীরে গুটি তৈরি হয়। গোপীবল্লভপুরের পায়রাশুলি গ্রামের কারুরাম মান্ডির কথায়, “এখন আমরা বছরে একবার কোকুন চাষ করি। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর— ৪৫ দিনেই গুটি পাই। ২২০০ টাকা কাহন (চার গুটিতে এক গণ্ডা, ২০ গণ্ডায় ১ পণ, ২০ পণে ১ কাহন) দামে গুটি বিক্রি করি মহাজনদের কাছেই। তাতে প্রায় ৫ হাজার টাকা লাভ থাকে।”
লাভজনক হলে সারা বছর চাষ হয় না কেন?
চলছে তসর পোকা বাছাইয়ের কাজ।—নিজস্ব চিত্র।
ওই চাষিদের কথায়, “জঙ্গলের গাছে সারা বছর চাষ করলে বনকর্মীরা বলেন, আমরা কোকুন চাষ করে গাছের ক্ষতি করি। তা ছাড়া বেশি গুটি তৈরি করলে বিক্রি করাটাও দায়। আমাদের যে মহাজনের উপর নির্ভর করতে হয়!”
এই অঞ্চলের চাষিদের চাষের পদ্ধতিতেও অবশ্য সমস্যা রয়ে গিয়েছে। বাঁকুড়ার প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত প্রদান কর্মী রাজেশ মিট জানালেন, গাছের পাতা অনুসারে ডিম ছাড়া, গাছগুলির ঠিক মতো রক্ষণাবেক্ষণ, গুটি পোকা বের হবার পর পাখির হাত থেকে তাদের সুরক্ষিত রাখতে মশারি ব্যবহার এগুলো ঠিক মতো পালন করলে উত্‌পাদন বাড়তে পারে দ্বিগুণ। সেই সঙ্গে ব্যবহার করা দরকার রোগশূন্য ডিম। মহাজনদের থেকে কেনা ডিমগুলি রোগশূন্য না হওয়ায় অনেক ডিম ২০-২২ দিনের মাথায় নষ্ট হয়ে যায়। এমন নানা কারণে ক্ষতি বাড়তে থাকায় বহু আদিবাসী পরিবার গুটি চাষ থেকে সরে আসছেন, প্রাথমিক সমীক্ষায় প্রদানের কর্মীরা।
আদিবাসী পরিবারগুলিকে গুটি চাষে ফের উত্‌সাহিত করতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যেরা প্রথমে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে প্রকল্পের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করবেন। তার পর নির্বাচিত এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কোকুন চাষ কী, তার প্রাথমিক ধারণা দিয়ে স্বনির্ভর দল গড়া হবে। সেই দল থেকে ইচ্ছুক কয়েক জনকে ডিম উত্‌পাদন করার কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে, চাষিদের ট্রাইভোল্টাইন থেকে বাইভোল্টাইন প্রজাতির গুটি চাষ করতে উত্‌সাহ দেওয়া হবে। তাতে উত্‌পাদন বাড়বে, তসরের মানও ভাল হবে। কোকুন উত্‌পাদনের পর তা বিপণন করবে উত্‌পাদকদের দিয়ে তৈরি সংস্থা (প্রোডিউসার্স কোম্পানি)। কোকুন চাষিরা ইচ্ছে করলে ওই কোম্পানির মাধ্যমে বিপনন করতে পারেন। না হলে নিজেরাও সরাসরি ক্রেতাকে বিক্রি করতে পারেন। অর্থাত্‌ প্রশিক্ষণ এবং পরিকল্পনার স্তরে চাষিরা দলবদ্ধ ভাবে কাজ করলেও, বিক্রির সময়ে তাঁদের স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ থাকবে।
গোপীবল্লভপুর ১ ব্লকের কৃষি আধিকারিক সৌগত নাথের কথায়, এই ব্লকের মোট জমির প্রায় দশ শতাংশ অনুর্বর। সেখানে একমাত্র সম্ভব তসরের কোকুন বা কাজুর মতো চাষ। তা ছাড়া, এখানে জঙ্গল থাকায় তসর সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। রাজ্য সরকারের টেক্সটাইল (সেরিকালচার) বিভাগের অন্যতম কর্তা বিজয় মুখোপাধ্যায়ও এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
অর্ণববাবু বলেন, “আমরা একশো দিনের প্রকল্পে অর্জুন গাছের চারা লাগানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্লকের পঞ্চায়েতগুলির কাছে আবেদন করব। তাতে কাজের সুযোগ যেমন তৈরি হবে, তেমনই ওই গাছগুলিতেই কোকুন বসানো হবে। কোকুন অর্জুন পাতা খেয়ে তসর মথ-এ পরিণত হবে। তার পর সেখান থেকে সুতো বার করা হবে। চক্রটি সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে ৪০-৭০ দিন। অর্থাত্‌, বছরে তিনটি চাষ সম্ভব। তা ছাড়া, উষর জমিতে গাছ লাগানোয় এক দিকে বনসৃজন হবে, অন্য দিকে স্থানীয় মানুষের জ্বালানি কাঠের জোগানও মেটাবে পুরানো অর্জুন গাছগুলিই।” তসর চাষের প্রতি ধাপে পেশাদারিত্ব সহজ প্রযুক্ত থাকবে বলেও তিনি জানান।
আর মাওবাদী সমস্যা? ওই সংস্থার কর্তাদের দাবি, তাঁরা দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে মূলত আদিবাসীদের সঙ্গে নানা উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। তাতে স্থানীয় মানুষ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। এর জন্যই তাঁদের কোনও প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়নি।

(সহ প্রতিবেদন: সুমন ঘোষ)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.