|
|
|
|
রাহুলকে তীব্র আক্রমণ কানপুরে |
গোবলয়েও মোদী ছুঁলেন না হিন্দুত্ব |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • কানপুর |
সঙ্ঘ ও দল তৈরি করছে হিন্দুত্বের জমি। কিন্তু সেই জমিতে দাঁড়িয়েও সম্প্রীতি ও উন্নয়নের স্বপ্ন বুনলেন তিনি! পুরোপুরি এড়িয়ে গেলেন হিন্দুত্বের প্রসঙ্গ। নিজস্ব কৌশলেই আজ উত্তরপ্রদেশে প্রচার-যাত্রা শুরু করলেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী।
এ পর্যন্ত যে রাজ্যেই তিনি গিয়েছেন, সেখানেই ‘মোদী-মোদী’ রব উঠেছে। আজ ওঠেনি, এমন নয়। তবু ভিড় আজ ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিও তুলেছে। মোদীর আগে আজ একই মঞ্চ থেকে কল্যাণ সিংহ, বিনয় কাটিয়ার, রাজনাথ সিংহ ও অমিত শাহরা বারবার টেনে এনেছেন এ রাজ্যের সাম্প্রতিক গোষ্ঠী সংঘর্ষের প্রসঙ্গ। হিন্দুদের উপর আক্রমণ ও মুলায়ম সিংহ যাদব ও তাঁর ছেলে অখিলেশের মুসলিম তোষণের কথা তুলে তাঁরা উস্কে দিয়েছেন হিন্দু আবেগকেও। এমনকী, জনতারও প্রত্যাশা ছিল, এক সময় ‘হিন্দুত্বের পোস্টার বয়’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা মোদী হিন্দুত্বের কথাই বলবেন।
কিন্তু না। তাঁর আগের বক্তারা হিন্দুত্বের জমি তৈরি করে রাখলেও মোদী তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষলেন না। তিনি বরং বললেন, “ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি ঢের হয়েছে। লোকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। কিন্তু আমি তো বলি হিন্দু আরও ভাল হিন্দু হোক, মুসলমান আরও ভাল মুসলমান হোক। সরকারের কাজ সকলের উন্নয়ন করা। অথচ দেশের ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেস ভাই-ভাইকে আলাদা করে। আমি চাই জোড়ার রাজনীতি।”
এটা কার্যত সঙ্ঘ ও বিজেপি-র রচনা করা চিত্রনাট্য। যেখানে সঙ্ঘ ও বিজেপি-র একাংশ বলবে হিন্দুত্বের কথা, আর মোদীর মুখে থাকবে শুধুই উন্নয়ন। কারণ, দিল্লির মসনদ দখল করতে গোবলয়ের সব থেকে বড় রাজ্য থেকে গত লোকসভার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি আসন হাসিলের লক্ষ্য নিয়েছেন মোদী। এবং এই লক্ষ্য পূরণ করতে নিজেও তিনি উত্তরপ্রদেশ থেকে ভোটে লড়তে পারেন। অন্তত দলের তরফে সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে প্রকাশ্যেই। সেই রাজ্যে পা দিয়ে মোদী আজ পুরোপুরি সঙ্ঘ-বিজেপি-র রচনা করা কৌশলই মেনে চললেন।
কারণ মোদী জানেন, দিল্লির তখ্তে পৌঁছতে হলে সমাজের সব ক্ষেত্রেরই সমর্থন জরুরি। তাই হিন্দু আবেগকে উস্কে নেপথ্যে দল ও সঙ্ঘের নেতারা যে কাজ করছে করুন, মোদী নিজে সেই কথা বলে বিরোধীদের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিতে চান না। কারণ, গোটা দেশের তীক্ষ্ন নজর এখন তাঁর উপরে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বা শুধুই হিন্দুদের নেতা হয়ে থাকলে চলবে না, সারা দেশের নেতা হয়ে উঠতে হবে তাঁকে। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের বিকল্প শক্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে হবে নিজের নেতৃত্বকে। তার জন্য চাই নতুন এক প্যাকেজ। এবং তার দক্ষ বিপণন। |
|
প্রণত: কানপুরের জনসভায় নরেন্দ্র মোদী। শনিবার। ছবি: পিটিআই। |
কী সেই নতুন প্যাকেজ? মোদী আজ তারও রূপরেখা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। দ্বিতীয় দফার মনমোহন সিংহের সরকার আম-আদমির মন জয়ের লক্ষ্যে খাদ্য-সুরক্ষার মতো কয়েকটি বিল পাশ করিয়েছে অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে। সরকারের দেয় ভর্তুকির টাকা যাতে সরাসরি সমাজের সব চেয়ে গরিব মানুষটির হাতে গিয়ে পৌঁছয়, তারও ব্যবস্থা করছে। দেশের গরিব ভোটারদের পাশে টানার ক্ষেত্রে এগুলিকেই তুরুপের তাস করতে চাইছে কংগ্রেস। সনিয়া-রাহুলদের এই গরিব-বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টাকেই মোদী নস্যাৎ করতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অস্ত্র দু’টি। এক, কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র। দুই, মনমোহন সরকারের দুর্নীতি। উত্তরপ্রদেশে প্রথম দিনের প্রচারেই মোদী বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা পরিবারের ছেলে রাহুল গাঁধীর পক্ষে গরিবের বন্ধু হওয়া তো দূর, তাদের দুঃখ-দুর্দশা বোঝারই সাধ্য নেই তাঁর। রাহুলকে ‘কংগ্রেসের শাহজাদা’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “সোনার চামচ মুখে দিয়ে যাঁর জন্ম, তিনি কী করে গরিবি বুঝবেন? গরিবের জীবন তো কাটিয়েছি আমি। কেন্দ্রের এই সরকার গরিবকে বোঝে না।”
মোদীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপট আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিলেন দলের সভাপতি রাজনাথ ও অন্যরা। তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী তাঁর ছোটবেলায় প্ল্যাটফর্মে চা বিক্রি করেছেন। মোদী মঞ্চে আসার আগেই একে একে বিজেপি নেতারা তাঁকে গরিব ঘরের অনগ্রসর শ্রেণির নেতা হিসেবে তুলে ধরেছেন। মোদী নিজেও তাঁর বক্তৃতায় ছুঁয়ে গিয়েছেন সে কথা।
কংগ্রেসকে আক্রমণের সঙ্গে মোদী বিঁধেছেন দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধি রোধে ব্যর্থ মনমোহন সিংহ ও ‘সনিয়া গাঁধীর সরকার’-কেও। প্রাক্তন কয়লাসচিব যে ভাবে খোদ মনমোহনকেও দুর্নীতির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, সেই প্রসঙ্গ তুলে তিনি তালিও কুড়িয়েছেন।
সভা উত্তরপ্রদেশে। স্বাভাবিক ভাবেই মোদীর নিশানায় ছিলেন আরও দুই কুশীলব। মুলায়ম সিংহ যাদব ও মায়াবতী। যাঁরা কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের জিয়নকাঠি। উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক গোষ্ঠী সংঘর্ষের প্রসঙ্গ সরাসরি না তুলেও মোদী আজ ঘুরপথে টেনে আনলেন রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার কথা। তুললেন উত্তরপ্রদেশে পুলিশের গুলিতে নির্দোষদের প্রাণ হারানোর কথা। জনতার মন টানতে নানা গল্প শুনিয়ে তুলনা টানলেন গুজরাতের সঙ্গে। আর মায়াবতীর দলিত ভোট বিজেপি-র ঝুলিতে টেনে আনার লক্ষ্যে শোনালেন গুজরাতর কাহিনি। যেখানে উত্তরপ্রদেশের থেকেও বেশি হারে দলিতরা এখন সে রাজ্যের উন্নয়নের শরিক। টানলেন অম্বেডকরের প্রসঙ্গও।
মেরুকরণের জমিতে এই নতুন প্যাকেজে নতুন ভাবে মেলে ধরার লক্ষ্য একটাই। দিল্লির তখ্ত। নিজেও স্মরণ করিয়ে দিলেন, এই উত্তরপ্রদেশই আট জন প্রধানমন্ত্রী দিয়েছে দেশকে। সেই রাজ্যে জনতার কাছে মাথা নত করে হাতজোড় করে তাই আশীর্বাদ চাইলেন মোদী।
এ হল শুরু। লোকসভা ভোটের আগে মোদী এর পর আরও আটটি সভা করবেন উত্তরপ্রদেশে। সভা শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস বিজেপি নেতাদের। তাদের দাবি, উত্তরপ্রদেশে প্রথম সভা সফল। অখিলেশ সরকার কম চেষ্টা করেনি যাতে সভায় লোক না আসে, তা সুনিশ্চিত করতে। তা-ও মানুষ শুধু মোদীর কথা শুনতে এই ভরা রোদে ছুটে এসেছেন। কানপুরের অনতিদূরে এখন খনন চলছে সোনার ভাণ্ডারের সন্ধানে। কিন্তু গোবলয়ে পা রেখে আজ বাজিমাত করে গেলেন বিজেপি-র সোনার ছেলে।
|
পুরনো খবর: সোনার স্বপ্ন দেখানোর পথে মোদীর বাধা স্বপ্নের সোনাও |
|
|
|
|
|