কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্তের জেরে এই মুহূর্তে সাঁড়াশি সঙ্কটে পড়েছে কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় সরকার। ঘরোয়া আলোচনায় সরকারের শীর্ষ মন্ত্রীরা মনে করছেন, তদন্তে কোথাও বড় ভুল করছে সিবিআই। প্রাক্তন কয়লাসচিব পি সি পারেখ ও শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম বিড়লার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও অভিযোগের তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারেন না। কারণ যে সময় হিন্দালকো-কে খনি বণ্টন করা হয়েছে, সে সময়ে কয়লা মন্ত্রক ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আবার সিবিআইয়ের এই ‘ভুলে’ সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসছে শিল্পমহল ও আমলাতন্ত্র। লোকসভা ভোটের আগে কোনও ভাবেই যা কংগ্রেসের কাম্য নয়।
প্রশ্ন হল, তা হলে বিড়লা ও পারেখের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার ব্যাপারে সিবিআই-কে কেন সবুজ সঙ্কেত দিল প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়? সিবিআই তদন্তে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের প্রভাব খাটানোর ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। এ ক্ষেত্রেও তারা তা করতে পারত।
জবাবে সরকারের এক শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা বলেন, এফআইআর দায়ের করার আগে সিবিআই কোনও অনুমতিই চায়নি সরকারের কাছে। গোটা তদন্ত এখন চলছে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় বা সরকারের তরফে আগ বাড়িয়ে তদন্তে কোনও বাধা দেওয়া হলে আরও বড় সমস্যা হতে
কুমারমঙ্গলম বিড়লা |
পারত। খনি বণ্টন নিয়ে তদন্তের ফাইল সিবিআইয়ের কাছ থেকে চেয়ে পাঠানোয় সম্প্রতি হাত পুড়েছে সরকারের। আইনমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে অশ্বিনী কুমারকে। সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে এ বার সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফার দাবি উঠত। হতে পারে তাই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সব জেনেশুনে চুপ করে থেকেছে।
মূলত এই প্রেক্ষাপটেই এখন সিবিআই তদন্ত নিয়ে সমালোচনায় নেমেছেন সরকার এবং কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা। মন্ত্রিসভার সদস্য বা ক্ষমতাসীন দলের নেতা হিসাবে সিবিআইয়ের সমালোচনা করার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী আনন্দ শর্মা, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী সচিন পায়লট থেকে শুরু করে একাধিক মন্ত্রী সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। কেন্দ্রের এক শীর্ষ সারির মন্ত্রীর ধারণা, সিবিআইয়ের তদন্তে কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে। কুমারমঙ্গলম বিড়লার বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতি ও লেনদেনের প্রমাণ তাদের কাছে আদৌ রয়েছে কিনা সন্দেহ। শুধুমাত্র কয়লাসচিবের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য কারও নামে এফআইআর করা যেতে পারে না। ওই মন্ত্রীর কথায়, সিবিআইয়ের এই ভুলের জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রীও অভিযুক্তের তালিকায় চলে আসার উপক্রম হয়েছে।
মজার বিষয় হল, গত কাল পর্যন্ত সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে বিড়লা ও প্রাক্তন কয়লাসচিবের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা সিবিআই তদন্তের সমালোচনায় নামার পরে বিজেপি নেতা যশবন্ত সিন্হা আজ বলেন, “সিবিআইকে তদন্তের সুযোগ দেওয়া উচিত। এই সরকার এতই দুর্নীতিপরায়ণ যে সিবিআইয়ের মতো তদন্ত এজেন্সিকেও কাজ করতে দিচ্ছে না।”
সিবিআই প্রধান রঞ্জিত সিংহ অবশ্য তাঁদের তদন্ত প্রক্রিয়ার পক্ষে আজ যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে খনি বণ্টন নিয়ে তদন্ত চলছে। সিবিআই এ ক্ষেত্রে রুল বুক মেনে চলছে। আমাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে যে প্রাক্তন কয়লাসচিব স্ক্রিনিং কমিটির সিদ্ধান্তকে নাকচ করে বিড়লাদের খনি বণ্টন করেছিলেন।” তবে সিবিআই ডিরেক্টর এ-ও জানিয়েছেন, তদন্ত নেহাতই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। অভিযুক্তরা আত্মরক্ষার জন্য সব রকম যুক্তি-তথ্য দিয়ে সিবিআইকে সাহায্য করতে পারেন।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, সিবিআই সূত্রে আজ এ-ও বলা হয়েছে যে তদন্তের সূত্র ধরে এ বার ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ককেও জেরা করা হতে পারে। কারণ, বিড়লাদের হিন্দালকোকে কয়লা খনি পাইয়ে দেওয়ার জন্য নবীনও চিঠি লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। রাজনৈতিক ভাবে এ ঘটনাটিও এখন ভাবাচ্ছে কংগ্রেসকে। কারণ, মাত্র দু’দিন আগেই
নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন নবীন। কংগ্রেসের আশঙ্কা, সিবিআইয়ের অতিসক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে নবীনের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালাতে পারে বিজেপি।
তবে সিবিআই তদন্ত নিয়ে কংগ্রেসের মূল আশঙ্কা এখন মূলত দু’টি। এক লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রীর ওপর যেন সরাসরি কোনও অভিযোগ এসে না পড়ে। এবং দুই শিল্পমহলের অসন্তোষ। কংগ্রেসের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, সাধারণ নির্বাচনে শিল্পমহলের একটা নির্ণায়ক ভূমিকা থাকে। এমনিতেই বণিকমহলের একটা অংশ মোদীতে মজেছেন। ভোটের আগে শিল্পমহলের কর্তারা যদি চটে কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, সেটা কোনও ভাবেই সুখের হবে না। তাই হাইকম্যান্ডের তরফে গত কাল আনন্দ শর্মা ও সচিন পায়লটদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা যেন কুমার বিড়লার পক্ষে দাঁড়ান। এর আগে টুজি বিতর্কের সময় এ ভাবেই শিল্পমহলের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সলমন খুরশিদের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তবে ক্ষত পূরণের এই চেষ্টা কত দূর সফল হবে, তা সময়ই বলবে।
|