|
|
|
|
ভোটের পরের প্রস্তুতি, ইতিহাস পড়ছেন প্রণব |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
ভোটের মরসুম দরজায় কড়া নাড়ছে। নিয়মনিষ্ঠ মানুষটির খাটাখাটনিও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিকরা সকলেই একটা কথা স্বীকার করেন। মন্ত্রী থাকাকালীনই হোক বা রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক দায়িত্ব নিয়েই হোক, রুল-বুক তথা সংবিধানের বাইরে কখনও এক কদমও যাননি এই পক্ককেশ বঙ্গসন্তান। প্রণববাবু নিজেও কথাটা হরবখত বলেন, বিশ্বাস করেন রুল-বুক মেনে নিয়মমতে চলাটাই তাঁর কাজ। কিন্তু কেন্দ্রে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা ঠিক কী, সংবিধানে তার এক কথায় কোনও নির্দিষ্ট উত্তর নেই। সেই জন্যই প্রণববাবু এখন নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছেন। ভারতের ইতিহাস মায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ইতিহাস ঘেঁটে দেখছেন, কোন সময় কে কী পদক্ষেপ করেছেন। নেড়েচেড়ে দেখছেন অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার সংবিধানও।
২০১৪-য় পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন। ভোটের বাজনা ইতিমধ্যেই বাজতে শুরু করেছে। সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন জনমত সমীক্ষার ফলাফলও আসছে। যাদের অনেকগুলোই দাবি করছে, আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস বা বিজেপি, কারও পক্ষেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছনো মুশকিল। জনমত সমীক্ষার মত মানুন বা না মানুন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন সম্ভাবনা যে প্রবল তা বিলক্ষণ জানেন প্রণববাবু। আর সেই জন্যই তাঁর কপালে ভাঁজ। একক গরিষ্ঠতা না পেলে কোন দলকে সরকার গড়তে ডাকবেন, সেটা রাষ্ট্রপতিই ঠিক করেন। এ ব্যাপারে রুল-বুক কী বলছে?
সেটাই খুঁজে দেখছেন প্রণববাবু। ইতিহাসের নানা নজির মিলিয়ে দেখেই তিনি নিজের কর্তব্য পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ঠিক কীসের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কোনও দলকে সরকার গঠনের জন্য যোগ্য বলে মনে করবেন? প্রাপ্ত আসন সংখ্যার ভিত্তিতে নাকি সমর্থকদের সংখ্যা ধরে? এর কোনও নির্দিষ্ট পথনির্দেশ সংবিধানে নেই। এমনকী ৪২ এবং ৪৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে বিল বা অর্ডিন্যান্স ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা যে ভাবে সংকুচিত করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে সেটাও হয়নি। সংবিধানের ৭৫ (১) ধারায় শুধু বলা আছে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মতো মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও নিয়োগ করবেন। সুতরাং স্পষ্ট গরিষ্ঠতা না থাকলে কাকে সরকার গড়তে প্রথম ডাকা হবে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে অনেকটা নিজস্ব বিবেচনার উপরেই নির্ভর করতে হয়।
ভারতীয় সংবিধান যার দ্বারা অনেকাংশে অনুপ্রাণিত, সেই ব্রিটিশ ঐতিহ্যেও বিষয়টা এ রকমই ছিল। প্রণববাবু ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছেন, ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সরকার গঠন নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। তখন সিংহাসনে রানি ভিক্টোরিয়া। সংখ্যালঘু সরকারের প্রধানমন্ত্রী লর্ড সালিসবেরি সেই বিতর্কে যোগ দিয়ে বলেছিলেন, “সংবিধান অনুযায়ী সার্বভৌম অধীশ্বর যার যোগ্যতার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন, তারাই সরকার গঠন করবে।” এই ‘সন্তুষ্টি’ কীসে আসবে, সেটাই হল প্রশ্ন এবং প্রণববাবুকেও ভাবাচ্ছে সেটাই। ঘটনাচক্রে বিলেতে সালিসবেরি পরে বিপুল গরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন এবং ব্রিটেনের ইতিহাসে তিনিই সর্বাধিক সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় সংবিধান যখন রচনা হয়েছিল তখন জোট সরকার যে হতে পারে, সেই বিষয়ে প্রণেতাদের কোনও ধারণাই ছিল না। ফলে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনও নির্দেশিকা সংবিধানে নেই। ১৯৭৭ সালের আগে পর্যন্ত এ নিয়ে কোনও রাষ্ট্রপতিকে মাথা ঘামাতেও হয়নি। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা সরকারের পতনের পর মোরারজি দেশাই জনতা জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। জোটের পক্ষে প্রয়োজনীয় গরিষ্ঠতা থাকায় তখন কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু ১৯৭৯ সালে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হন চরণ সিংহ। জোটে তখন ভাঙন ধরেছে। চরণের পক্ষে জোটের মাত্র ৬৪ জন সাংসদের সমর্থন ছিল। কিন্তু কংগ্রেস বাইরে থেকে তাঁকে সমর্থন করেছিল। রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি তখন জগজীবন রামকে না ডেকে চরণকেই সরকার গড়তে ডেকেছিলেন এবং এক মাসের মধ্যে সংসদে গরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বলেছিলেন। যে দিন চরণ গরিষ্ঠতা প্রমাণ করবেন, তার এক দিন আগে সমর্থন তুলে নেয় কংগ্রেস। চরণ পরের দিন সংসদেই পদত্যাগ করেন। সরকার ভেঙে দিয়ে নতুন করে ভোটে যাওয়ার নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি।
ফের সমস্যার সূত্রপাত নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার জমানায়। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সর্বাধিক আসন পেয়েছিল বিজেপি। যদিও তা প্রয়োজনীয় ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২-এর থেকে অনেক কম ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে অটলবিহারী বাজপেয়ীকেই সরকার গড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান শর্মা। কিন্তু যথেষ্ট শরিক দলের সমর্থন না থাকায় ১৩ দিনের মাথায় সেই সরকারের পতন হয়। ফলে লোকসভা নির্বাচনে সবথেকে বেশি আসন পাওয়া দলকেই সরকার গড়তে ডাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়।
১৯৯৬ সালের ভোটে দেবগৌড়ার নেতৃত্বে জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। কংগ্রেস তাকে বাইরে থেকে সমর্থন করছিল। কিন্তু এক বছরের মাথায় দেবগৌড়ার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করে তারা। ফলে সরকার ফের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতির আসনে তখন কে আর নারায়ণন। কিন্তু সে বার তখনও বাজেট পাশ হয়নি, হয়নি ভোট অন অ্যাকাউন্টও। তার মধ্যে অন্তর্বর্তী নির্বাচনে গেলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়ত। কংগ্রেস তখন আই কে গুজরালকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রপতি তাঁকেই সরকার গড়তে ডাকেন। এক বছর পর ১৯৯৮ সালে গুজরালের পতন হয়। বিতর্ক এড়াতে ’৯৮-এর সাধারণ নির্বাচনের পর অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সরকার গড়ার জন্য ডাকলেও নারায়ণন এ বার আগে থেকে শরিক দলের সমর্থনের চিঠি দেখতে চেয়েছিলেন। বাজপেয়ী চিঠি দেখান, সংসদেও গরিষ্ঠতা প্রমাণ করেন। কিন্তু ১৩ মাস পরে সমর্থন প্রত্যাহার করেন জয়ললিতা। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের পরীক্ষায় এক ভোটে হেরে যায় বাজপেয়ী সরকার। ফলে ফের ভেঙে যায় সরকার।
এখন প্রশ্ন হল, ২০১৪-য় কী হবে? কোনও দল একক ভাবে ২৭২টি আসন পেয়ে গেলে কোনও সমস্যা নেই। প্রাক-নির্বাচনী জোট ২৭২ ছুঁলেও সমস্যা নেই। কিন্তু তা না হলে? কাকে ডাকা হবে সরকার গড়তে? সর্বাধিক আসনপ্রাপ্ত দলকে? নাকি কম আসন পেয়েও জোট শরিকদের একত্রিত করে সরকার গড়ার দাবি নিয়ে হাজির হওয়া শিবিরকে? সে ক্ষেত্রে প্রাক নির্বাচনী সমঝোতা নাকি নির্বাচনোত্তর সমীকরণ, কোনটা প্রাধান্য পাবে? এরই সমাধানের খোঁজে এখন
আদ্যন্ত রুল-বুক মেনে চলা প্রণববাবু যে নিয়মের বাইরে পা দেবেন না, তা ধরেই নিচ্ছেন ঘনিষ্ঠেরা। এ পি জে আব্দুল কালাম, প্রতিভা পাটিলরা প্রথা মেনে এগিয়েছেন। নিজস্ব বিবেচনার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। ইতিহাসের গলিঘুঁজি ঘুরে প্রণববাবু কোন নিয়মনীতিতে ‘সন্তুষ্ট’ হন, সেটাই এখন দেখার। |
|
|
|
|
|