কুড়ি বছরে এক ডজন টেস্ট এই ইডেনের বুকে। ১৯৯৩-এর জানুয়ারিতে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল গ্রাহাম গুচের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, সেই যাত্রা শেষ হতে চলেছে এ’বছর নভেম্বরে।
ইডেনে যে বার প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন ২০ বছরের সচিন তেন্ডুলকর, তার এক বছর আগেই পারথে তাঁর সেই হইচই ফেলা ১১৪ রানের ইনিংস। সেই সিরিজে সিডনিতেও অপরাজিত সেঞ্চুরি (১৪৮) ছিল তাঁর। সদ্য টিন এজ পেরনো ছেলেটার এমন বীরদর্পে ক্রিকেট দুনিয়া দাপানো দেখে এই শহরেরও কম আগ্রহ জন্মায়নি সে বার। সচিনের ১৯৯তম টেস্ট হতে চলেছে ইডেনে এই ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার পর স্মৃতি রোমন্থনে ডুবে গিয়েছে বাংলা। রাজু মুখোপাধ্যায় থেকে বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় সবাই যেন ফিরে যাচ্ছিলেন কুড়ি বছর আগে।
এ বার কী হতে পারে? সচিন তেন্ডুলকরকে যে ভরা ইডেনই অভিবাদন জানাবে, বিশ্বাস সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। ‘ছোটবাবু’র প্রাক্তন অধিনায়ক মঙ্গলবার বলছিলেন, “ইডেনের একটা আসনও যেন খালি না থাকে, সেটাই চাইব। সচিনকে যে তার শেষ সিরিজে দেখতে পাবে ইডেন, সে জন্য বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের ভাগ্যবান বলতে হবে। আশা করি, এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করবেন না।”
কুড়ি বছর আগে সেই টেস্ট যিনি মাঠে বসে দেখেছিলেন, সেই প্রাক্তন ক্রিকেটার রাজু মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “পারথে সেই সেঞ্চুরিটার জন্যই তো সে বার সচিনকে নিয়ে বাড়তি আগ্রহ ছিল ইডেনের। ওই বয়সের একটা ছেলে যে দেশে-বিদেশে এমন পারফরম্যান্স দেখাচ্ছে, এটাই তখন ভারতীয় ক্রিকেটে বড় আলোচনার বিষয়। ১৯৯৬-এর পর তো সৌরভ-রাহুল-লক্ষ্মণকে পেয়ে সাপোর্ট পেল সচিন। তার আগে তেমন যোগ্য সঙ্গত পায়নি ও। অথচ তখনও ওর ব্যাটে কী দাপট। সেই দাপট দেখতেই ইডেনের গ্যালারি ভরে গিয়েছিল।” পুরোপুরি হতাশ করেননি সচিন। প্রথম ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন। ইংল্যান্ডকে ফলো অন করিয়ে যখন ভারত সেই টেস্ট আট উইকেটে জিতল, তখনও ক্রিজে প্রিয় বন্ধু বিনোদ কাম্বলীর সঙ্গে সচিন। দু’জনেই নট আউট। “কাম্বলীর সঙ্গে সচিনের প্রথম টেস্ট খেলতে নামা তো সেবারেই”, যোগ করলেন রাজু।
সেই ম্যাচে ইডেনে থাকা আর এক প্রাক্তন ক্রিকেটার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “তখনই শুনতাম, নেটেই যা সব শট মারত, তা দেখে অবাক হয়ে যেত সবাই। বেঙ্গসরকরের মুখ থেকে শোনা, ও একবার ছোট্ট সচিনকে মুম্বইয়ের নেটে ডেকে এনে চমকে গিয়েছিল। বেশিরভাগ বলই লিফট করছিল। যে বোলাররা প্রথমে কেডস্ পরে বল করছিল, তারাই পরে স্পাইক পরে এসে বল করা শুরু করল। ইডেনে সেই ইনিংসটা দেখে মনে হয়েছিল, কথাগুলো মোটেই মিথ্যে নয়। সেই টেস্টেই বুঝিয়েছিল, কত বড় মাপের ক্রিকেটার আসছে।” |
ইডেন তখন ইডেন এখন |
টিকিট |
১৯৯৩: সে বার সাধারণ দর্শকের জন্য টিকিটের দাম ছিল ২০০ এবং ১০০ টাকা। দৈনিক টিকিট বিক্রি হয়েছিল ৪০ এবং ২০ টাকায়।
২০১৩: সিএবি সূত্রে খবর, সিজন টিকিটের দাম ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। দৈনিক টিকিট রাখার ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। |
দর্শক |
১৯৯৩: মাঠে আসন সংখ্যা ছিল পঁচাশি হাজার। শেষ দিন ভর্তি হয়ে গিয়েছিল গোটা ইডেন।
২০১৩: দর্শক আসন কমে ৬৮ হাজারের মতো। সিএবি আশাবাদী, প্রথম দিন থেকেই কানায় কানায় ভরে যাবে স্টেডিয়াম। |
পিচ |
১৯৯৩: সে বার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সচিনের ভারত ইডেনের বাইশ গজে স্পোর্টিং উইকেট পেয়েছিল। পিচের বাউন্স কাজে লেগেছিল কুম্বলে, রাজু, রাজেশ চহ্বাণদের। পিচ তৈরি করেছিলেন প্রবীর মুখোপাধ্যায়।
২০১৩: ‘টেলর মেড’ না হলেও এ বার পিচ সচিনের মতো ব্যাটসম্যানদের পছন্দসই হবে। এ বারও পিচের দায়িত্বে প্রবীরবাবু। |
স্টেডিয়াম |
|
১৯৯৩: ইডেনের পুরনো ড্রেসিংরুম, গ্যালারি এখনকার মতো আকর্ষণীয় ছিল না। ফ্লাডলাইট তখনও বসেনি। সাইট স্ক্রিন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না সচিন।
২০১৩: নতুন করে সংস্কারের পর এখন পুরো স্টেডিয়ামেই দর্শকদের জন্য বাকেট চেয়ার। ঝাঁ চকচকে ‘বি’, ‘সি’, ‘কে’, ‘এল’ ব্লক। জুড়েছে নতুন কর্পোরেট বক্সও। ক্লাব হাউসের বাইরে নিজের বিশাল পোর্ট্রেট মাঠে ঢোকার সময় দেখবেন সচিন। সাইট স্ক্রিন নিয়েও এখন কোনও অভিযোগ নেই লিটল মাস্টারের। |
মাঠের লড়াইয়ে |
১৯৯৩: অধিনায়ক ছিলেন আজহারউদ্দিন। ইডেন টেস্ট ছিল সচিনের ২২তম। ২১ টেস্টে ১১৫৮ রান ও ৪ সেঞ্চুরি নিয়ে নেমেছিলেন সচিন।
২০১৩: এ বার অধিনায়ক ধোনি। সচিন খেলতে নামবেন ১৯৮ টেস্টে ১৫ হাজার ৮৩৭ রান, ৫১ সেঞ্চুরি নিয়ে। |
শেষ দুই
৬-১০ নভেম্বর ইডেন
১৪-১৮ নভেম্বর ওয়াংখেড়ে |
|
তখন ইডেনে নিয়মিত খেলা দেখতে যাওয়া অন্য জগতের মানুষদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। তিনিও ’৯৩-এর সেই ম্যাচের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে বললেন, “সে দিন সচিনের ব্যাটিং দেখে ‘দিওয়ার’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের উদ্দেশে ইফতিকারের ডায়লগটা মনে পড়ে গিয়েছিল। তুমি তো অনেক দূর যাবে, বাবা এ ধরনেরই ছিল সংলাপটা। ইডেনে সচিনের প্রথম টেস্টে যখন ছিলাম, আশা করি শেষ টেস্টেও থাকব। চেনা সচিনকে দেখার আশা নিয়েই যাব।”
যাবেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার অরুণলালও। বললেন, “ইডেনে ওর প্রথম টেস্টটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই শেষটা দেখার ইচ্ছা খুব রইল। এই ইডেনেই তো ওর অনেকগুলো ভাল ইনিংস দেখেছি। শোয়েবের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওর রান আউট হওয়া নিয়ে যা হয়েছিল একবার, তাও মনে আছে। তবে শেষ ম্যাচটায় ভাল কিছু করুক, এটাই চাইব।” ইদানীং মাঠে যাওয়া বন্ধ করে দিলেও প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আশা, “ওর ফর্ম ভাল না থাকলেও আমার বিশ্বাস, সচিনের সেঞ্চুরি করার ক্ষমতা এখনও রয়েছে। তাই ইডেনে শেষ টেস্টে সচিন আমাদের একটা সেঞ্চুরি দিতেই পারে।” তবে কিংবদন্তি ফুটবলার চুনী গোস্বামীর সাফ কথা, “ইডেনে শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি না করতে পারলেই বা কী? সচিন আমাদের মনে যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। ওর মতো গ্রেটদের ভোলা যায়?”
|
শেষ সিরিজের আগে রঞ্জিতে
নিজস্ব প্রতিবেদন |
জীবনের শেষ টেস্ট সিরিজের মহড়া। ২৭ অক্টোবর থেকে হরিয়ানার অদূরে লাহলিতে মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফির ম্যাচে নামবেন সচিন তেন্ডুলকর। নিজেই এই ম্যাচে খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করে মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার কর্তাদের জানিয়েছেন। সংস্থার যুগ্মসচিব নীতিন দালাল বলেন, “তেন্ডুলকর ছাড়াও ওই ম্যাচে জাহির খানও খেলবে বলে জানিয়েছে।” গত বছরও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে নামার আগে মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি ম্যাচে খেলেছিলেন সচিন এবং সেঞ্চুরিও করেন। তবে সে বার ম্যাচটি ছিল ওয়াংখেড়েতে।
|