প্রবন্ধ ২...
তেলঙ্গানা একটা বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে

ষাটের দশকে ভারতে কর্মরত ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক বার্নার্ড নসিটার। ১৯৬৭ সালে যে দিন লোকসভায় ভাষা বিল পাশ হয়েছিল সে দিন তিনি প্রেস গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন। তখন লোকসভার স্পিকার সঞ্জীব রেড্ডি। ৫২১ জনের লোকসভা। ভাষা বিল পাশ হয় ২২৪-৭৫, শাসক-বিরোধী এই ভোটের অঙ্কে। সে দিনের বর্ণনায় নসিটার লিখেছেন, সংসদে ঢুকে মনে হচ্ছে এটাই হচ্ছে এক বিচিত্র ভারত; কেউ পাগড়ি পরে আছে তো কেউ শাড়ি, আর নেহরু নিজের পাশ্চাত্য পোশাকে। সংসদের বাইরে বিশেষ করে আগরা এলাকায় তখন ব্যাপক ইংরেজি-বিরোধী আন্দোলন চলছে। কলমে ইংরেজি শব্দ লেখা থাকলে ছাত্ররা পকেট থেকে সেই কলম কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন। একই অবস্থা করছে ইংরেজি শব্দ লেখা বিদেশি ক্যামেরার। আর যে মুহূর্তে বিলটি পাশ হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল দক্ষিণ ভারতে বিশেষত তামিলদের হিন্দি বিরোধী আন্দোলন। সর্বভারতীয় পরীক্ষায় হিন্দিভাষীরা মাতৃভাষায় পরীক্ষা দেবে, আমরা কেন ইংরেজিতে দেব? এই ভয়াবহ আন্দোলন দেখে নসিটার লিখেছিলেন, ভাষা নিয়ে আন্দোলন যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ভারতের জিহ্বার সংশয়’ তা আজ ইন্দিরা গাঁধী ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু এ দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা আগামী দিনে যে আবার মাথাচাড়া দেবে না তা বলা যায় না। বরং ভারত এতটাই নরম রাষ্ট্র যে, বোধহয় ভবিষ্যতে এই অখণ্ড ভারতের ঐক্য ফের বিপদের মুখে পড়তে পারে। মার্কিন সাংবাদিকের সে দিনের আশঙ্কা কি তবে সত্য হতে চলেছে?
ভারতকে এক অখণ্ড মহাজাতি হিসাবে বিকশিত হওয়ার পথে প্রধান বাধা এক দিকে যেমন ছিল ধর্মীয় মেরুকরণের সমস্যা, অন্য দিকে সংবিধানের জন্মলগ্ন থেকেই ভাষার রাজনীতিও ভারতকে খণ্ডবিখণ্ড করেছে। অম্বেডকর নিজে বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে ভেবেছেন, কিন্তু তাঁর মতের মধ্যেও ধারাবাহিকতার অভাব ছিল। প্রথম প্রথম তিনি ছোট ছোট রাজ্যে দেশ ভাগ করার পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু পরে ভেবেছিলেন, এই ভাবে না ভাঙলে দেশের বিচ্ছিন্নতা ও স্থানীয় সত্তার স্বশাসন রক্ষা করাও সম্ভব নয়। মহারাষ্ট্র থেকে মুম্বইকে আলাদা করার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন নেহরু। কিন্তু অম্বেডকর তার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি হয়েছিল, যার ফল হল পৃথক রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ। তার আগে পৃথক অন্ধ্রের জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হয়। কিন্তু মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে অন্ধ্রকে আলাদা করতে রাজি ছিলেন না তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী রাজাগোপালাচারী। নেহরু নিজেও যে ভাষাভিত্তিক রাজ্য বিভাজন পছন্দ করতেন তাও নয়, কিন্তু তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধিকার না দিলে ভারতকে ধরে রাখাও কঠিন হবে।

অবিভক্ত রাজ্যের দাবি। অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুরমে বিক্ষোভ। অক্টোবর, ২০১৩। ছবি: এএফপি
বিবিধের মাঝে মিলন মহান এমন একটি স্লোগান, যা পাঠ্যপুস্তকে মুখ ঢেকে থাকে। ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠীর মন্তব্য: ‘এ আজাদি’ একেবারে ‘ঝুটা’ না হলেও বলা যায় জন্মসূত্রে প্রতিবন্ধী। মুঘল আমলে প্রশাসনের প্রয়োজনে আমলারা স্থানীয় ভাষা শিখতেন। সে দিনও কিন্তু বহু ভাষার সংস্কৃতি ভারতে ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে চান বা না চান একটা আধুনিক ভারতের জন্ম দিচ্ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা ইংরেজির বিরোধিতা করে বসলাম। কেম্ব্রিজ ভারতের পঠনপাঠনে সক্রিয় ছিল, আন্দোলন করে ব্রিটিশদের সঙ্গে তাঁদেরও আমরা তাড়ানোর ব্যবস্থা করলাম। তবু অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক সংঘাত বাড়ল বই কমল না।
সুতরাং পুরনো প্রশ্নটা থেকেই গেছে: আমরা কি আদৌ একটা ঐক্যবদ্ধ নেশন? যুদ্ধের সময়, তা চিনই হোক বা পাকিস্তান, আমরা ঐক্যবদ্ধ থেকেছি। তা থেকে বোঝা যায়, যতই ভাষা এবং সংস্কৃতির বিবাদ থাকুক না কেন ভারতীয় মানুষের মধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক ঐক্য আছে। সম্ভবত শুধু পৃথক সত্তার কাল্পনিক ধারণা থেকে তাড়িত আলাদা আলাদা আঞ্চলিক জাতি ভাবনা নয়, ক্ষমতার রাজনীতিও আসলে শক্তিশালী কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করে বিবিধ আঞ্চলিক শক্তিকে বিকশিত করেছে এ দেশে। কাজেই শুধু ভাষা বা জাতির সমস্যা নয়, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসনের সংঘাতও অখণ্ড ভারতের গদিকে বার বার টলিয়ে দিচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান ছয় দশক ধরে খুঁজছে ভারতের মানুষ। কখনও স্লোগান উঠছে শক্তিশালী রাষ্ট্রের, কখনও বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের। হয়তো সমাধান সূত্র আছে এরই মাঝামাঝি কোনও পরিসরে, যেখানে আঞ্চলিক স্বাধিকার অখণ্ড জাতীয়তাবাদের পীড়ার কারণ হবে না।
পৃথক রাজ্য গঠনের প্রশ্নে অম্বেডকরের মত সময়ের হাত ধরে বিবর্বিত হয়েছে। কিন্তু অম্বেডকরের একটা মন্তব্য বোধহয় আজ স্মর্তব্য। তিনি বলেছিলেন, স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লাভের কথা না ভেবে শীতল মস্তিষ্কের বিচারবুদ্ধি দিয়ে পৃথক রাজ্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। এটাও বলা যায়, পৃথক রাজ্য গঠন মানেই ভারতের ‘বলকানাইজেশন’ নয়। আবার যেন তেন প্রকারেণ পৃথক রাজ্য গঠনই যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তির পথও নয়। সুতরাং কোন ক্ষেত্রে বিভাজন হবে আর কোন ক্ষেত্রে হবে না, তার জন্য চাই রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং সুষ্ঠু বিচারবুদ্ধি।
খণ্ড এবং অখণ্ড সত্তার এই দ্বন্দ্ব ঘোচাতে সমাধানের প্রকৃত রাস্তা একটাই। সেটা হল কথোপকথন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সদাসর্বদা আলোচনার পথে যদি আমরা নিযুক্ত না থাকি, তবে সেখান থেকেই বাড়ে পরমত-অসহিষ্ণুতা। আর সেখান থেকেই জন্মায় হিংসা। সরকার যদি দুর্বল হয় তবে অনেক সময়ে যুক্তি তক্কো আর আলোচনার বদলে পেশিশক্তির কাছে আত্মসমর্পণই দস্তুর হয়ে ওঠে। এক দিকে হিংসা-সংঘাত আর অন্য দিকে আত্মসমর্পণ এই দ্বিধার মাঝামাঝি একটা পরিসর আছে। যেখানে সরকার বা কোনও প্রতিষ্ঠান তার ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব নিয়ে আলোচনাকে প্রধান নীতি হিসাবে চিহ্নিত করবে এবং আলোচনার নিরন্তর প্রক্রিয়া চালু রাখবে। তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, কোন রাজ্য পৃথক হবে কোন রাজ্য পৃথক হবে না। দ্বিতীয় দফার ইউ পি এ-র সরকারকে কেবলই দুর্বল হতে দেখেছি, সেই সরকারই এখন ভোটের মুখে আকস্মিক শক্তিশালী হতে চাইছে। দেখাতে চাইছে, তার খুব সাহস, সে খুব অনমনীয়। কিন্তু লোকদেখানো হিম্মতদারি নয়, প্রকৃত সুষ্ঠু আলোচনার পথে হাঁটলে বরং সমাধানের রাস্তা সহজ হয়। সব কিছুই ভোটের মুখে সারতে হবে, এই চিন্তা বর্জন করে প্রতিটি বিচ্ছিন্নতার বিষয়, খণ্ড এবং অখণ্ড সত্তার প্রতিটি সংঘাত পৃথক পৃথক বিষয় হিসাবে আলোচনা করা হোক। আমি কোথাও সংখ্যালঘু আবার সেই আমিই কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই বিশাল ভারতে তাই নির্বাচনী রাজনীতির আবেগ বর্জন করে যুক্তির পথে হাঁটাই এখন বিধেয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.