এ বারের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে খুশি হবেন এক দল বিজ্ঞানী। ইংরেজি শব্দরীতি ধার করলে যাঁদের বলা যায় ‘আরামকেদারা-আসীন’ গবেষক। বিশেষণটি প্রায়শ নিন্দার্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা নয়। আমি বলতে চাইছি, বিশেষ শ্রেণির গবেষকদের কথা, যাঁরা রাতের পর রাতে জাগেন না যন্ত্রের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে, বা হাতে কালিঝুলি মাখেন না ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে করতে। এমন গবেষকদের বলা হয়ে থাকে তাত্ত্বিক। বিশেষণটিতে শ্রদ্ধা এবং অবজ্ঞা, দুই-ই মিশে থাকে। আমি এখানে ওই দুইয়ের কোনটিই ইঙ্গিত করছি না। আমি শুধু জাত বোঝাতে বলছি, আরামকেদারা-আসীন বিজ্ঞানীদের কথা।
ওঁরা খুশি, কারণ ওঁদের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে-অক্ষরে ফলেছে। সময় বদলেছে, এখন আর বিজ্ঞানীর গজদন্তমিনারে বসে থাকলে চলে না। তাঁকে যে গবেষণা করতে হয়, তার আবার সামাজিক প্রয়োজনীয়তাও থাকা দরকার। এর সঙ্গে জনগণকে যদি খানিকটা বিনোদন উপহার দেওয়া যায়, তা হলে তো কথাই নেই। এই পরিস্থিতি অগ্রাহ্য করা যায় না, কারণ এখন গবেষণায় লাগে পেল্লায় যন্ত্রপাতি। সে সব যন্ত্র সামাজিক প্রয়োজনের দায় যদি নাও বা মেটায়, তা হলেও তাদের জটিল জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। বহ্মাণ্ড কী দিয়ে গড়া, পদার্থের ক্ষুদ্রতম উপাদান কী কী, এমন সব জটিল প্রশ্ন। যার উত্তর মানুষ খুঁজে চলেছে কয়েক হাজার বছর ধরে। প্রয়োজনীয় তেমনই এক পেল্লায় যন্ত্রের নাম লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এল এইচ সি), জেনিভা-র কাছে সার্ন গবেষণাগার যার ঠিকানা। বহু ব্যয়ে নির্মিত এই যন্ত্র খুঁজেছে কূট প্রশ্নাদির উত্তর। প্রশ্নের উত্তরে সমাজের কোনও হেরফের হবে না, তবু তো প্রশ্ন বলে কথা। বিজ্ঞানীর আর কাজ কী, প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ছাড়া? |
হিগ্স-বোসন কণার সন্ধানে। প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ। ছবি: এএফপি/সার্ন |
অর্ধশতাব্দীকাল ধরে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ জ্বালা থেকে সহস্র মাইল দূরে যাঁদের জীবনযাপন, সেই আরামকেদারা-আসীন বিজ্ঞানীরা গড়ে তুলছিলেন নানা প্রশ্নের উত্তরের এক মালা। মালাটির চরিত্র, বলাই বাহুল্য, সাধারণের বোধগম্যের বাইরে। তা বাস্তব না অলীক, সেটা পরীক্ষা করাও নিতান্ত কঠিন। এমন কঠিন যে পদার্থবিদ্যার সব শাখার গবেষকরা সবটা বুঝবেন না, বুঝবেন কেবল তাঁরা, যাঁরা একেবারে নির্দিষ্ট শাখার কাজে মগ্ন। এমন জটিল ব্যাপারে টাকা ঢালবেন রাজনৈতিক নেতারা? প্রশ্ন ছিলই। শেষমেশ মিলেছিল অনুদান। সমাজ বুঝিয়ে দিয়েছিল জটিল প্রশ্নের উত্তর সন্ধানেও তার আগ্রহ আছে। অবশ্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও সব কিছুর অন্য একটা দিকও ছিল। পথচলতি মানুষকে বোঝানোরও দায় ছিল যে, প্রচুর ব্যয়ের একটা উপযোগিতা আছে। করদাতারা ফেরত পাবেন করের মূল্য। এ কারণেই সর্বান্তকরণে চেষ্টা করা হয়েছিল ‘হিগ্স-বোসন’ কণাটিকে প্রচণ্ড গরিমাময় করে তোলার। যথেষ্ট বুদ্ধি খরচ করে কণাটির একটি যুতসই নামও ফাঁদা হয়েছিল। ‘ঈশ্বর কণা’। প্রচারযন্ত্র ঢাক পিটিয়ে বলেছিল, ওই কণা মানুষের অস্তিত্বের মূলে।
‘হিগ্স-বোসন’ ছিল এলএইচসি-র মূল অন্বিষ্ট। তাকে কেন খুঁজতে হবে? হবে, কারণ নতুন শতাব্দীর শুরুতে ব্রহ্মাণ্ডের মূল উপাদান হিসেবে কণার তালিকায় শুধু ওটিই ছিল অনাবিষ্কৃত। ব্রহ্মাণ্ডের উপাদানের যে ছবিটি বিজ্ঞানীরা এঁকেছিলেন (নাম যার ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’), তাতে কণার সংখ্যা ছিল ২৪। এর মধ্যে অর্ধেক কণা বাকি অর্ধেক কণার মধ্যে বিক্রিয়ার মূলে দায়ী। ভাল কথা, কিন্তু এই ২৪টি কণা তাদের নিজ নিজ ভর পেল কোথা থেকে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে ২৫তম কণা ‘হিগ্স-বোসন’-এর আমদানি। তত্ত্বে যার আমদানি, তার অস্তিত্ব প্রমাণে চাই পরীক্ষা। তা হয়েছে। খোঁজ মিলেছে মহামূল্যবান কণার। এবং যেহেতু বিজ্ঞানী পিটার হিগ্স বয়সে অশতিপর হলেও এখনও জীবিত, তাই ঝুলে রয়েছিল নোবেল প্রাইজের প্রশ্ন।
প্রশ্ন থেকে গেল। ভবিষ্যৎবাণী মিললে, পুরনো ধাঁধার সমাধান দিলে, তাত্ত্বিক গবেষক পান নোবেল শিরোপা। পূর্বাভাস মেলার, কিংবা প্রশ্নের উত্তর দান যাচাই হয় পরীক্ষার কষ্টি পাথরে। আলবার্ট আইনস্টাইন এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু পদার্থের পঞ্চম অবস্থার পূর্বাভাস দেওয়ার ৭০ বছর পরে পরীক্ষা প্রমাণ করে যে ওঁদের অনুমান ছিল ঠিক। তত দিনে প্রয়াত হয়েছেন ওঁরা দু’জনে। তাই, পরীক্ষায় ওঁদের তত্ত্ব প্রমাণের কৃতিত্বে যখন নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল আধুনিক গবেষকদের, তখনও উঠেছিল প্রশ্নটা। নোবেল শিরোপা জিনিসটা কি অবিচার করেনি সত্যেন্দ্রনাথের ওপর? মানে, সেই বিজ্ঞানীর প্রতি, যিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন পরীক্ষায় নয়, তত্ত্বে। রুশ ধনকুবের ইউরি মিলনার মনে করেন, স্বীকৃতি প্রদানে তাত্ত্বিক গবেষকদের অবহেলা করা অন্যায়। তাই তিনি গত বছর চালু করেছেন বিশেষ কিছু পুরস্কার, যা ধার্য তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য। ভারতীয় হিসেবে এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হল, কারণ আমাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী অশোক সেন অন্তর্ভুক্ত ছিলেন প্রথম পুরস্কার বিজেতাদের তালিকায়।
ফিরে আসি ‘হিগ্স-বোসন’-এর প্রসঙ্গে। ব্রহ্মাণ্ডের উপাদান মূলত দু’জাতের কণা। ফের্মিয়ন এবং বোসন। ২৪টি কণার মধ্যে ১২টি ফের্মিয়ন, বাকি ১২টি বোসন। ২৫তম কণা বা ‘হিগ্স-বোসন’ কিন্তু ওই দ্বিতীয় জাতের। বলা উচিত একটা কথা। ফের্মিয়ন বা বোসন ওদের নামের সঙ্গে যুক্ত হলেও, যাঁদের কল্যাণে ওই নাম, যথাক্রমে এনরিকো ফের্মি এবং সত্যেন্দ্রনাথ, কিন্তু কণাগুলির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। যোগাযোগ পরোক্ষে। ২৫তম কণাটির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কিন্তু স্যর পিটার হিগ্স একা নন। এর পিছনে অবদান অনেকের। যাই হোক, গত বছর যন্ত্রে কণাটি শনাক্ত হওয়ার পর থেকে মিডিয়ার কল্যাণে, প্রচারের ঢক্কানিনাদের স্রোতে ভেসে গিয়ে আরামকেদারা-আসীন বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছিলেন নোবেল পুরস্কার মিলবেই ২৫তম কণার সুবাদে। হলও তাই। প্রাইজ পেলেন স্যর পিটার এবং ফ্ঁরাসোয়া এঙ্গলার্ট।
কিন্তু শুধু দু’জনে কেন? এতে প্রমাণ হয় এক ব্যাপার। জনপ্রিয় বিজ্ঞান মানে সত্যের অপলাপ। এত দিন ‘ঈশ্বর-কণা’ সংক্রান্ত মিডিয়ার প্রচারে কিন্তু শোনা যায়নি এঙ্গলার্টের নাম। কেন যায়নি, অনুমান করা কঠিন নয়। হিরো যদি এক জন হন, তা হলে ঢাক পেটাতে সুবিধে। একাধিক হিরো আবার হিরো নাকি?
আসলে ১৯৬৪ সালে তথাকথিত ঈশ্বর-কণার পূর্বাভাস দানের পিছনে হিগ্স, এঙ্গলার্ট ছাড়াও যাঁদের অবদান ছিল, তাঁরা রবার্ট ব্রাউট, টম কিব্ল, জেরাল্ড গুরালনিক, কার্ল হাগেন। ১৯৬৪র আগের গবেষণা ধরলে, উঠে আসে আরও দু’টি নাম। ফিলিপ অ্যান্ডারসন এবং জেরার্ড টি’হুফ্ট। ওঁদের বাদ দিয়ে পুরস্কার দেওয়া হল শুধু দু’জনকে। এমনকী ব্রাউট, যিনি পেপার ছেপেছিলেন এঙ্গলার্টের সঙ্গে, তিনি নেই পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায়। তিনি প্রয়াত, তাই নেই। কিন্তু অ্যান্ডারসন এবং টি’হুফ্ট বাদে অন্যেরা নেই কেন? ওঁরা দু’জনেই নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন অন্য গবেষণার জন্য। নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না তিনের বেশি চতুর্থ, পঞ্চম বা ষষ্ঠ ব্যক্তিকে। নিয়মের কারণে যোগ্য ব্যক্তিরা বাদ পড়লেন কিনা, ভেবে দেখার সময় এখন।
এ সব থেকে কী শিখলাম? এক, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানকে শুধু জনমনোরঞ্জনের জন্য তরল করে প্রচার করা উচিত নয়। উচিত নয় ত্রুটিহীনতার স্বার্থে। দুই, নোবেল পুরস্কার গবেষকের মেধা যাচাইয়ের শেষ মাপকাঠি নয়। আর তিন, সমাজ যদি সবুজ সংকেত দেয় জটিল পরীক্ষানিরীক্ষার প্রস্তাবে, শুধু আশু ফললাভের চিন্তা বিসর্জন দেয়, তা হলে সেই দাক্ষিণ্যের প্রতিদান অবশ্যই মেলে।
তিনটি শিক্ষাই, আমি মনে করি, গুরুত্বপূর্ণ। ওগুলি না মানলে বিপদের আশঙ্কা। তা শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর সর্বত্র। জনগণ (পড়ুন, করদাতা) যদি ভেবে বসেন, মিডিয়ায় যা নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, একমাত্র সেটাই গবেষণা, বাকি সব মূল্যহীন, সুতরাং বর্জনীয়, তা হলে বিপদ। তখন গবেষককে তাঁর কাজ ছেড়ে খুঁজতে হবে মিডিয়া-প্রচার, তিনি ভুলে যাবেন তাঁর নিষ্ঠা কীসে নিবেদিত থাকা দরকার। নোবেল পুরস্কার নিয়ে ফি বছর দেখি হইচই। ওই পুরস্কার পেতে গবেষকদের প্রত্যাশাও আকাশচুম্বী। কিন্তু তার বাইরেও থাকেন অনেকে, যাঁরা প্রত্যাশা থেকে দূরবর্তী। গবেষক চান বা না চান, তিনি অনুদানের জন্য সমাজের মুখাপেক্ষী। আর, অনুদান মঞ্জুরের দায়িত্বে থাকেন রাজনীতিকরা। আশু প্রতিদানের কথা ভুলে তাঁদের দূরদ্রষ্টা হওয়া জরুরি। নচেৎ, তাত্ত্বিক গবেষণার মৃত্যু অনিবার্য। |
ইলাহাবাদে হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা। |