অসুখ অপেক্ষা চিকিৎসা যে অধিকতর প্রাণঘাতী হইতে পারে, এই কথাটি মধ্যবিত্ত এখন বিলক্ষণ জানে। ইহার প্রধানতম কারণ হিসাবে অভিযোগ করা হইয়া থাকে, যে নামজাদা সংস্থাগুলির ঔষধের নাম ব্যবস্থাপত্রে লিখিতে চিকিৎসকরা অভ্যস্ত, সেই সংস্থাগুলির উৎপাদন ব্যয়ের সহিত ঔষধের দামের কোনও সামঞ্জস্য নাই; বিজ্ঞাপন, চিকিৎসকদের মনোরঞ্জন, প্রতিনিধি পালন ইত্যাদি উৎপাদন-অতিরিক্ত ক্ষেত্রে সংস্থাগুলি যে বিপুল ব্যয় করে, সেই খরচ তাহারা নাচার রোগীর পকেট হইতেই ফেরত লয়। এই অভিযোগ কতখানি সত্য, তাহা লইয়া তর্ক থাকিতে পারে, কিন্তু এ বিষয়ে সংশয় নাই যে ঔষধের ক্রেতাদের ক্ষমতা উৎপাদক ও বিক্রেতার অপেক্ষা অনেক কম।
এই বৈষম্য প্রশমনের উপায় কী? পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি উপায় করিয়াছে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ঔষধের দোকান খোলা হইয়াছে, যেখানে বাজারদরের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ খরচেই ১৪২টি জীবনদায়ী ঔষধ পাওয়া যায়। এই বৎসর জানুয়ারি মাসে এই জাতীয় ন্যায্য মূল্যের দোকান হইতে ঔষধ কিনিয়াছিলেন ৪৫,০০০ মানুষ। অগস্ট মাসে আসিয়া সংখ্যাটি পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি পৌঁছাইয়াছে। সকল সংস্থার উৎপাদন-অতিরিক্ত ব্যয় সমান নহে। ফলে, সব সংস্থার ঔষধের দামও সমান নহে। চিকিৎসক তাঁহার ব্যবস্থাপত্রে ঔষধটির ব্র্যান্ডনেম (অর্থাৎ, কোনও একটি বিশেষ সংস্থার ঔষধের নাম) না লিখিয়া জেনেরিক নেম (অর্থাৎ, ঔষধটির মূলগত নাম) লিখিলে যে সংস্থার ঔষধের দাম সর্বনিম্ন, দোকানি সেই ঔষধটিই বেচিতেছেন। সরকারি দোকানে যেহেতু প্রভূত পরিমাণ ঔষধ বিক্রয় হয়, বহু সংস্থা কম লাভেই ঔষধ বেচিতে রাজি হইয়াছে।
রাষ্ট্রপন্থীরা দাবি করিবেন, ইহা বাজারের উপর রাষ্ট্রের জয়। বাজার যেখানে মূল্য বিকৃত করিতেছিল, রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করিয়া তাহা ঠিক করিয়া দিয়াছে। দাবিটি শুনিতে গালভরা, কিন্তু ফাঁপা। ইহা বাজারেরই জয়, কারণ রাষ্ট্র এখানে সর্বশক্তিমান ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে নহে, বাজারের একটি চরিত্র হিসাবে মঞ্চে নামিয়াছে। সত্য, খেলার নিয়মটি সামান্য পাল্টানো হইয়াছে, কিন্তু তাহা বাজারের চরিত্রের বিপ্রতীপ নহে, বরং তাহার সহিত সংগতিপূর্ণ। প্রতিযোগিতার বাজারের নিয়ম হইল, যদি বাজারে মুনাফার হার স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি থাকে, তবে নূতন বিক্রেতা বাজারে প্রবেশ করিবে, এবং অপেক্ষাকৃত কম লাভে পণ্য বেচিবে। যত ক্ষণ না মুনাফার হার স্বাভাবিকে পৌঁছাইতেছে, তত ক্ষণ এই প্রক্রিয়াটি চলিবে। ঔষধের বাজারে, দৃশ্যতই, মুনাফা অ-স্বাভাবিক ছিল। সরকার সেই বাজারে ঢুকিয়াছে। যে সংস্থাগুলি কম দামে ঔষধ বেচিতে পারে এবং চাহে, অথচ বাজার-অতীত কোনও কারণে তাহা পারিতেছিল না, তাহাদের জন্য জায়গা তৈরি করিয়া দিয়াছে। বাজার তাহার ধর্ম হইতে বিচ্যুত হয় নাই, রাষ্ট্র তাহার ‘রাষ্ট্রপনা’র বাহিরে আসিয়াছে। বাজারে হস্তক্ষেপ করিতে চাহিলে ইহাই পথ। ঔষধের বাজারেই হউক, মুরগি বা মাছের বাজারেই হউক। তাহার জন্য রক্তচক্ষু দেখাইয়া দাম কমাইবার হুকুম জারি করিতে হয় না। বাজার যদি অন্যায় মুনাফার পথে হাঁটিতে থাকে, তাহাকে স্বধর্মে ফিরাইয়া আনিবার দায়িত্বটি অবশ্যই রাষ্ট্রের। বাজার তাহার কুশলতার জন্য জরুরি, জনগণমঙ্গল-বিধানের জন্য জরুরি। সেই ধর্ম হইতে বাজার চ্যুত হইলে তাহাকে নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে। কিন্তু তাহা এই পথে। রাষ্ট্রীয় দাদাগিরির মাধ্যমে নহে। |