একটি দেশ, দুটি ঘটনা। একটি ঘটনায় একদা প্রাণহানি অপরিহার্য ছিল। অন্যটিতে মৃত্যু প্রত্যাশিতই নহে। ঘটিল অন্যরূপ। এক দিকে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দুটি রাজ্যের উপকূলে ঝড় আছড়াইয়া পড়িল, তাহার গতিবেগ ছিল ঘন্টায় দুই শতাধিক কিলোমিটার। মৃত্যু তবু ২৫ ছাড়ায় নাই। চোদ্দো বৎসর পূর্বে ওই ওড়িশাতেই সুপার-সাইক্লোনে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মারা গিয়াছিলেন। অন্য দিকে, মধ্যপ্রদেশে শতাধিক পুণ্যার্থী মারা গেলেন। ওড়িশায় এক, আর মধ্যপ্রদেশে অন্য রকম ফল হইল কেন? কারণ, ভারত বস্তুত দুইটি দেশ। একটি দেশ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কাজে লাগাইয়া দুঃসাধ্য কাজও সমাধা করিয়া ফেলে। অপর ভারত সহস্রাব্দ-প্রাচীন ব্যবস্থার সংস্কার ঘটাইতে নারাজ। এ দেশে প্রায় বৈদিক যুগ হইতে দেবস্থানগুলির ভিতর-বাহিরে বিধিব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হয় নাই। কোন মন্দিরে কে পূজা দিবার যোগ্য, কে পৌরোহিত্য করিবে, কে গর্ভগৃহে প্রবেশ করিবে, পাণ্ডা-জাতীয় কোনও মধ্যস্থতাকারী থাকিবে কি না, এই সকল ব্যবস্থা যেমন একই রূপ থাকিয়া গিয়াছে, তেমনই সংস্কার হয় নাই মন্দিরগুলির বাহ্যিক আকার-প্রকারেরও। দেবালয়গুলির অন্তঃস্থলে সংকীর্ণ স্থানে বহু মানুষের ভিড় জমিয়া যায়। প্রবেশ এবং প্রস্থানের পথগুলিও অবাধ যাতায়াতের অনুকূল নহে। সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটিই জনস্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তার পরিপন্থী। সরকার এই সকল দেবস্থানে যাতায়াতের বন্দোবস্ত করে, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, যানবাহন সরবরাহ করে বটে। কিন্তু তাহা ভগ্নপ্রায় সৌধে পলেস্তারার প্রলেপের ন্যায়। বাস্তবিক সংস্কার দ্বারা তীর্থস্থানে ও দেবালয়ে জনস্রোত নিয়ন্ত্রণ করিবার কাজটি করা হয় না। মন্দিরগুলি পাণ্ডাদের নিয়ন্ত্রণাধীন, নিরাপত্তারক্ষীদের প্রভাব সেখানে সামান্যই। তিথিগুলিতে অবস্থা আরও ভয়ানক হয়। পুণ্যার্থীরা উন্মত্ত হইয়া হুড়াহুড়ি করে, পদপিষ্ট হইয়া নারীশিশুবৃদ্ধরা মারা যায়, এমন বহু নিদর্শন আছে। কোনও সরকারি বন্দোবস্তই এ ধরনের জনসমাগমের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। অপঘাত মৃত্যুর শঙ্কা এড়াইবার একমাত্র উপায় পুণ্যার্থীদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া, অতিরিক্ত তীর্থযাত্রীদের ফিরাইয়া দেওয়া। তৎসহ দেবস্থানগুলির ভিতর ও বাহির পরিকাঠামোর বিজ্ঞানসম্মত সংস্কারের ব্যবস্থাও করিতে হইবে। নইলে এমন অঘটনই নিয়তি।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দ্বারা নিয়তি জয় করিবার কাজটিও সহজ নহে। ওড়িশায় আবহাওয়া দফতরের আগাম সতর্কবার্তা শিরোধার্য করিয়া প্রশাসন যে ভাবে সম্ভাব্য বিপদের এলাকা হইতে প্রায় সাড়ে আট লক্ষ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরাইয়া লইয়াছে, তাহা ঐতিহাসিক। তাহাতে অবশ্য সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি, গবাদি পশুর মৃত্যু ইত্যাদি এড়ানো যায় নাই। ‘পিলিন’ ঝড়ের প্রকোপ কমিলেও তাহার পর বন্যায় বহু মানুষ বিপদগ্রস্ত হইয়াছেন। তাহাদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া সময় এবং ধৈর্য দাবি করে। সেই দাবি প্রশাসনকেই পূরণ করিতে হইবে। প্রয়োজনীয় অর্থ ও লোকবল বরাদ্দ করিতে হইবে। উত্তেজনা ফুরাইলে আর্ত লোকগুলি অন্তরালে চলিয়া না যায়।
এই সকল ব্যবস্থাপনা সহজ। দুই ভারতকে মিলাইবার কাজটি কঠিন। তাহার কারণ দুর্বোধ্য নহে। বিজ্ঞানের কাজ ব্যবহারিক জগৎ লইয়া। সেখানে হাতেনাতে ফল মেলে। কোনটি কার্যকরী, কোনটি নহে, তাহা প্রত্যক্ষ হইয়া যায়। তাই অবৈজ্ঞানিক বিধির প্রতি আস্থা কমিয়া আসে। চিকিৎসার নানা সাবেকি ধারা প্রচলিত থাকিলেও, মানুষ এই কারণেই এখন প্রধানত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপরেই নির্ভর করে। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে কিন্তু তাহার উপায় নাই। ইহার প্রাপ্তি মনোজগতে, প্রত্যক্ষ প্রমাণের স্থান সামান্যই। তাই অকারণ অভ্যাসের সহিত শাস্ত্রোক্ত ধর্মীয় বিধির পার্থক্য করা কঠিন। অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের জীবনদানের সহিত অজ্ঞানতা-জনিত গণমৃত্যুর সহাবস্থান তাই চলিতেছে। |