প্রবন্ধ ৩...
চোখে মুখে ‘আমরাও পারি’


আমরা গ্রামের মুখ্যু মেয়ে দিদি। আমরা কী আর বুঝি, আর কতটাই বা পারি? ওই সব হিসেবপত্র মাস্টাররা আমাদের চেয়ে ঢের ভাল করতে পারেন।
বক্তা: মিড-ডে-মিলের রান্নায় নিযুক্ত এক মহিলা। স্থান: পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার এক গ্রাম।

আমি কাঠ বিক্রি করি গ্রামের এক ছোট কারখানায়। সেখানে তা দিয়ে নানান জিনিস তৈরি হয়। এ ছাড়াও আমি পঞ্চায়েতের কুডুম্বশ্রী শাখার সঙ্গে যুক্ত।
বক্তা: এক সাধারণ মহিলা। কাঠ বিক্রি করে জীবিকা চালান। স্থান: কেরলের তিরুবনন্তপুরম জেলার এক গ্রাম।


ভারতের দুই প্রান্তের গ্রামের দু’জন শ্রমজীবী মহিলার দুটি মন্তব্য। দু’জনেই অল্পবিস্তর শিক্ষিত। দ্বিতীয় জন পঞ্চাশোর্ধ্ব, বিধবা, ছেলের কাছে আশ্রিতা। অথচ, প্রথম জনের কথায় ঝরে পড়ছিল হতাশার সুর। আর, দ্বিতীয় জনের গলায় শোনা গেল দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। কাঠ বিক্রি করে সংসার চালানো এই নারী গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, কুডু্ম্বশ্রীর শাখা অফিসে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনাতেও তিনি যোগ দেন। কুড়ুম্বশ্রী সরকারি সহায়তায় গঠিত কেরলের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যা প্রায় গত এক দশক ধরে গ্রামীণ পঞ্চায়েতেক সঙ্গে যৌথ ভাবে মহিলাদের জন্য কাজ করছে। আজ সে রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলায় কুড়ুম্বশ্রীর অফিস আছে। প্রতিটি গ্রামের সমস্ত পরিবারের এক জন মহিলা সদস্য এঁদের গ্রামীণ শাখার সঙ্গে যুক্ত। দলবদ্ধ ভাবে নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা ও তার সমাধান খুঁজে বার করার প্রচেষ্টাই জাগিয়ে দিয়েছে গ্রামের মহিলাদের আত্মবিশ্বাস, ‘আমরাও পারি’, এই বোধ, চেতনা। কেরলের ওই মহিলার উজ্জ্বল মুখে, প্রত্যয়ী হাসিতে তার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছিলাম।

ফিরে আসি পশ্চিমবঙ্গের ওই মহিলার কাছে। মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত গ্রামটি প্রধানত মুসলমান ও অনগ্রসর শ্রেণি অধ্যুষিত। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করা এই পরিবারগুলির দিন গুজরানের প্রধান ভরসা খেতমজুরি ও বিড়ি বাঁধা। স্কুলের মিড-ডে মিল নিয়ে কথা চলছিল। প্রথম থেকেই সেই আলোচনায় যোগ দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছিলেন বছর তিরিশের বয়সি এই রাঁধুনি মহিলা। মাস্টারমশাইদের কাছে না গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি শুনে অত্যন্ত অবাক হলেন এবং বারংবার নিজের অক্ষমতা ও অজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন। ক্লাস এইট পাশ হওয়া সত্ত্বেও একটি ছাপা লেখা পড়ার জন্য এগিয়ে দিলে অবিশ্বাসের হাসি হেসে বললেন, ‘আমি পারব না’ বারংবার পীড়াপীড়িতে শেষে পড়তে নিলেন।
এবং তাঁর পড়ার অনর্গল স্রোতকে আমি অবশেষে নিজের কাজের তাগিদে থামাতে বাধ্য হলাম। তত ক্ষণে তাঁর মুখ ‘আমি পেরেছি’র হাসিতে উদ্ভাসিত। উনি যে পড়তে পারেন, তা উনি বিস্মৃত হয়েছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী এক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে কেরলে ওই একই অবস্থায় বাস করা আর একটি নিম্নবর্গীয় পরিবারের মধ্যেকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের বিপুল তফাত। বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কেরলে প্রত্যক্ষ করা যায়, জাত-ধর্ম ও দলমত, প্রধানত রাজনৈতিক মত-অমত নির্বিশেষে এক সামূহিক উদ্যোগ, এই রাজ্যের বিকাশে যার বড় ভূমিকা। অনেক ক্ষেত্রেই এর কিছুটা বিপরীত মনোভাব লক্ষ করা যায় এই রাজ্যে, যেখানে উচ্চবর্গীয়রা সমাজের নিম্নবর্গীদের ভিতরে অত্যন্ত নিপুণ ভাবে ‘পারবি না’ মনোভাবের বীজ রোপণ করে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। অথচ সামান্য সুযোগেই নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে এই নবসচেতনতা ওই মেয়েটির মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দের জন্ম দিয়েছিল।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ‘কেপেবিলিটি’ বা সক্ষমতা বলতে বুঝিয়েছেন প্রত্যেক মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশ ও তাকে উপলব্ধির স্বাধীনতা, যা বহুলাংশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর কথাটির তাৎপর্য বুঝতে খুব সাহায্য করেছিল।

প্রতীচী ইনস্টিটিউটে গবেষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.