|
|
|
|
লাইফবোটে পাসপোর্ট আঁকড়ে দেড় দিন |
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় ও অমিত কর মহাপাত্র • হলদিয়া |
পিলিনের দাপটে বঙ্গোপসাগর তখন উথাল-পাতাল। ডুবছে এম ভি বিঙ্গো। প্রাণ বাঁচাতে জাহাজ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন ওঁরা ১৮ জন। পরের ৩৬ ঘণ্টা একটি লাইফ বোটে সেঁধিয়ে চার-পাঁচ মিটার উঁচু ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রায় ৭০ মাইল ভেসে চলা, শুধু একটা কিনারার খোঁজে। সম্বল বলতে শুধু প্রাণ আর পাসপোর্ট। শেষ পর্যন্ত ঢেউয়ের ধাক্কা আর সমুদ্রে ভেসে থাকার প্রশিক্ষণই ওঁদের পৌঁছে দিল তালসারি-লাগোয়া ওড়িশার বিচিত্রপুর দ্বীপে। সেখান থেকে হলদিয়ার হোটেল। নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছেও আতঙ্ক কাটেনি মাস্টার ক্যাপ্টেন হান জিয়ান ইউ-এর। বাকি ১৭ জন নাবিক-কর্মীও বিধ্বস্ত।
মঙ্গলবার বিকেলের দিকে ক্যাপ্টেন কিছুটা ধাতস্থ হলেও রা কাড়লেন না! যে কোনও প্রশ্নেই তাঁর একটা জবাব, ‘আই দোন্ত নো’। দুর্গাচকে হোটেলের ঘরে পাসপোর্ট-সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি শোকাতে ব্যস্ত ছিলেন জাহাজের চিফ অফিসার হু মিঙ্গ ঝু, ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ার এরিখ ডোরাডো। তাঁরা বোঝালেন, ঈশ্বরের দয়াতেই কোনওমতে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন। ‘জল-যুদ্ধে’র কৌশল জানা থাকলেও সাক্ষাৎ মৃত্যুর সঙ্গে এমন লড়াই এই প্রথম। হলদিয়ায় এই নাবিকদের তদারকিতে থাকা ভারতীয় শিপিং এজেন্ট সংস্থার কর্মী অশোক ঘোষ বলেন, “প্রায় ৭০ মাইল প্রাণ হাতে করে আসতে হয়েছে। এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি ওঁরা।” তিন দিন ধরে হলদিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে থাকা চিনা দূতাবাসের এক অফিসারের কথায়, “ভিসার ব্যবস্থা করে ওঁদের দেশে পাঠানোটাই প্রথম কাজ।” পূর্ব মেদিনীপুরের এসপি সুকেশ জৈন বলেন, “নাবিকদের অভিবাসন বিভাগ তিন দিনের হেফাজতে নিয়েছে। জাহাজ মন্ত্রকের তদন্ত শেষ হলেই চিনা নাবিকেরা দেশে ফিরে যাবেন।” খোঁজ মিলেছে জাহাজটিরও। কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ জানান, উপকূলরক্ষী বাহিনীর ভেসেল জাহাজটিকে চিহ্নিত করেছে। সাগর এবং স্যান্ড হেডের মধ্যে হলদিয়া চ্যানেল থেকে ২০ মিটার পূর্বে জাহাজটিকে দেখা গিয়েছে। চেয়ারম্যানের কথায়, “বিঙ্গোর খোঁজ মেলায় হলদিয়া আর কলকাতা বন্দরে জাহাজ চলাচলে সমস্যা থাকবে না।” |
|
দুর্গাচকের হোটেলের রাতের খাবারের অপেক্ষায় জাহাজের কর্মীরা। —নিজস্ব চিত্র। |
বন্দর সূত্রের খবর, এম ভি বিঙ্গো ১ অক্টোবর বাংলাদেশের মঙ্গলা বন্দর থেকে সাগরের স্যান্ড হেডে আসে। জাহাজের মালিক চিনা সংস্থা ‘উইজডোম (লাইনস) এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’। জাপানে তৈরি জাহাজটির রেজিস্ট্রেশন হয়েছে পানামায়। ১৮ জন নাবিকের ১৭ জন চিনা এবং এক জন ইন্দোনেশিয়ার বাসিন্দা। বিঙ্গো ৪ অক্টোবর হলদিয়া বন্দরে এসে ৬ হাজার টন আকরিক লোহা বোঝাই করে ৮ অক্টোবর সাগরের অ্যাঙ্করেজ পয়েন্ট-এর উদ্দেশে রওনা দেয়। ৯ অক্টোবর আরও ২১২৫ টন আকরিক লোহা বোঝাই করে জাহাজটি। ১১ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ চিন রওনা দেয় বিঙ্গো। কিন্তু পিলিনের দাপটে পরের দিন সাগরের দিকে ফিরতে শুরু করে জাহাজ। ওই রাতে সাগর অ্যাঙ্করেজ পয়েন্টে ৪৫ ডিগ্রি হেলে পড়ে বিঙ্গো। হু-হু করে জল ঢুকতে থাকে জাহাজে। নাবিকেরা ঝড়ের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েন মাঝসমুদ্রে। ১৩ অক্টোবর ভোরে বিপর্যয়ের কথা জানতে পারে উপকূলরক্ষী বাহিনী। শুরু হয় তল্লাশি। উপকূলরক্ষী বাহিনীর দিঘা মোহনা থানার ওসি বিপ্লব হালদার বলেন, “জিপিএস ব্যবস্থায় নাবিকেরা বিপদের কথা প্রথমে চিনে জানিয়েছিলেন। সেখান থেকে কলকাতা বন্দরে যোগাযোগ করা হয়। তারপর আমরা খবর পাই।”
১৩ তারিখ রাতেই জানা যায় জাহাজের নিখোঁজ নাবিক-কর্মীরা সম্ভবত ওড়িশার বিচিত্রাপুর দ্বীপের কাছাকাছি কোথাও রয়েছেন। পর দিন, সোমবার ভোরে বিচিত্রাপুর রওনা দেয় উপকূলরক্ষী বাহিনী। সেই দলে বিপ্লববাবুও ছিলেন। আর ছিলেন ওড়িশা বন দফতরের কর্মীরা ও ভোগরাই থানার আইসি দয়ানিধি দাস। দয়ানিধিবাবু বলেন, “ওই দ্বীপেই একটা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে ছিলেন নাবিকেরা। আমাদের দেখে ওঁরা যেন প্রাণ ফিরে পান।”
বিঙ্গোর ডুবে যাওয়ার কারণ কিন্তু স্পষ্ট নয়। কোনও জাহাজ ডুবলে তার মধ্যে ‘ইপিআইআরবি’ নামে একটি যন্ত্র তরঙ্গ ছাড়তে শুরু করে। চেন্নাইয়ে ইন্ডিয়ান নেভির বিশেষ স্টেশন থেকে তা বোঝা যায়। বিঙ্গো থেকে সেই তরঙ্গের হদিস মেলেনি। তদন্তকারী দলের এক কর্তার কথায়, “১১ অক্টোবর সাগর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের দিকে প্রায় ৯০ মাইল এগিয়েছিল বিঙ্গো। ঝড়ের পূর্বাভাস থাকায় ওই অঞ্চলে আরও কয়েকটি জাহাজ দাঁড়িয়েছিল। তারা ওখানে থেকে গেলেও বিঙ্গো পূর্ব সাগরের দিকেই উপকূলে ফিরতে শুরু করে। এটা কেন হল, স্পষ্ট নয়।” বন্দর সূত্রের খবর, আকরিক লোহার আর্দ্রতা ১০%-এর বেশি হলে তা জাহাজে তোলা হয় না। যে আকরিক জাহাজে ছিল, তার আর্দ্রতা প্রাথমিক রিপোর্টে ১২% ছিল। এর দু’এক দিনের মধ্যেই দ্বিতীয় একটি রিপোর্টে আর্দ্রতার পরিমাণ ১০% -এর কম দেখানো হয়। তাই জাহাজে লোহা তুলতে অনুমতি দেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয় রিপোর্টটি ঠিক ছিল কি না, জাহাজ মন্ত্রকের তদন্তকারী দল তা পরীক্ষা করে দেখছেন। সতর্কবার্তা সত্ত্বেও জাহাজটিকে কেন সাগরে ভেসে যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “দুর্যোগের পূর্বাভাস তো ছিলই। তাহলে কেন জাহাজটি ছাড়া হল?” বন্দর চেয়ারম্যানের ব্যাখ্যা, “নিয়মানুযায়ী জাহাজ আটকে রাখতে পারি না। তা ছাড়া, দুর্যোগের মধ্যে বন্দরে জাহাজ থাকলে ক্ষতি বেশি হত।” |
|
|
|
|
|