আতঙ্কের রাত কাটিয়ে বাঙালি আনন্দ-পুরীতে
ড় শেষের সকালেই এমন দৃশ্য দেখতে হবে কে ভেবেছিল!
রবিবার, নবমীতে স্বর্গদ্বারের মোড় পেরোতে সেই চেনা ছবিই চোখে পড়ল। পিলিনের ধাক্কায় বাঙালির প্রাণের পুরীর কী হল, তা নিয়ে কলকাতার জমজমাট পুজো মণ্ডপেও দুশ্চিন্তার ছায়া। কিন্তু পুরীর সৈকতে বিশ্রামরত ‘দাদা-বউদি’দের ভ্রূক্ষেপ নেই। উত্তাল ঢেউয়ে খাবি খাওয়ার চিরকেলে দৃশ্য। হঠাৎ দেখলে, কোনও বিপর্যয়ের রেশ বোঝা যায় না।
এই আপাত নিরুদ্বিগ্ন ছবিটা যে সব নয়, তা অবশ্য মালুম হল একটু বাদেই। সমুদ্রসৈকতে তাকাতেই চোখে পড়ল শনিবার রাতের তাণ্ডবের চিহ্ন। তটভূমিতে ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা বাতিস্তম্ভ। বড়-বড় গাছও কে যেন উপড়ে নিয়েছে। যত্রতত্র পড়ে রয়েছে, দোকানিদের ছাউনি, হোটেলের ছাদের কফিশপের হোর্ডিং। এলোমেলো হাওয়ায় ছত্রখান বালি ঢিপির আকার নিয়েছে। পরে বুলডোজার এনে পরিষ্কার করা হয় স্বর্গদ্বারের মূল রাস্তা।
ঝড়ের রাতটা আতঙ্কে কাটিয়েও সকালে বৃষ্টি থামতে সমুদ্রে নেমেছিলেন পর্যটকেরা। পুরীতে পৌঁছে দেখা গেল, তাঁদের জল থেকে তুলতেও প্রশাসনের কালঘাম ছুটছে। দুপুরের দিকে সমুদ্রে আবির্ভাব ঘটল, এক গদাধারী ‘হনুমানের’। ওড়িয়া-হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে তিনি হাঁকছেন, ‘উঠি পড়ো, ভাগো, পালাও!’ বেয়াড়া ছোকরারা তাঁর কথায় আমল না-দিলে পিঠে দু’এক বার গদার ঘা কষাতেও দ্বিধা করছেন না হনুমানজি। স্থানীয় পুলিশের এক কর্তা বোঝালেন, “কী আর করা? বহুরূপী দিয়েই মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে।”
বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ি। পুরী জেলার চন্দনপুরী এলাকায়। ছবি: সুমন বল্লভ।
স্বর্গদ্বারের নামজাদা হোটেলের কর্তা অবশ্য বললেন, “সকালের বা দুপুরের এই ফুরফুরে পুরীকে দিয়ে আগের দিনটা বোঝার চেষ্টা করবেন না।” সে-দিনই প্রশাসনের তৎপরতায় বেশ কিছু পর্যটক বিপদ এড়াতে ভুবনেশ্বরে চলে গিয়েছেন। শুধু প্রশাসন নয়, কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থাও তাদের হলিডে হোম থেকে পর্যটকদের নিখরচায় ভুবনেশ্বরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। বস্তুত, নবমীর সকালে পুরী পৌঁছে স্বর্গদ্বারের কাছে একটি বহুল পরিচিত হোটেলে ঘর পেয়ে যাওয়াটাও চমক তো বটেই। ঝড় ‘কভার’ করতে আসা সাংবাদিক-চিত্র সাংবাদিকদের ওই হোটেলের ম্যানেজার বললেন, “এই সময়ে ঘর পাওয়াটা কিন্তু সত্যিই বড় ঘটনা!”
তবে পুরী কখনওই খালি হয়নি। ভিড় কমেছে, কিন্তু চেনা ছবিটা হারিয়ে যায়নি। বরং যাঁরা রয়ে গিয়েছিলেন, আগের রাতটা আতঙ্কে কাটিয়ে পরের সকালেই সমুদ্রে নামার সময়ে তাঁদের মধ্যে কাজ করেছে অবিশ্বাস্য ভাবে বেঁচে যাওয়ার উল্লাস। আলিপুরের শুভাশিস বিশ্বাস বলছিলেন, “অষ্টমীর ওই রাতটা কোনও দিন ভুলব না। ঘরের বাইরে অবিশ্রান্ত সমুদ্রের সোঁ সোঁ গর্জন। সুনামির কথা মনে পড়ছিল। শুধু ভাবছিলাম, আমাদের হোটেলটা যেন ভাসিয়ে নিয়ে না-যায়!” শুভাশিসবাবুরা পুরী ছাড়ার ব্যবস্থা করতে না পারলেও প্রাণের দায়ে অনেকেই ১৫ হাজার টাকা খেসারত দিয়ে গাড়ি ভাড়া করেছেন। আবার প্রশাসনের পরামর্শে ছুটি বাতিল করে সপ্তমীর রাতে পুরী থেকে বিশেষ ট্রেনে ওঠেন টালিগঞ্জের গাঁধী কলোনির প্রবীণ দম্পতি রিনা ও গোপীনাথ দত্ত। পরে এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আফসোসও করেছেন।
নবমী-দশমীতে অবশ্য বাজারে দোকানদারেরা চড়া দর হেঁকেছেন। এক কেজি আলু বা পাঁউরুটির পাউন্ড ৫০ টাকায় বিকিয়েছে। মাছের ভাগেও টান পড়েছে। ঘরে বিদ্যুৎ না-থাকার অসুবিধেটা বাদ দিলে পর্যটকদের কাছে পরিস্থিতি ছিল মোটামুটি সহনীয়।
‘নিরাপদ’ ভুবনেশ্বরে গিয়ে বরং অনেক পর্যটকই মুশকিলে পড়েছেন। যাদবপুরের দম্পতি অর্ক দাশগুপ্ত ও স্মিতা খাটোর সপ্তমীর রাতেই ভুবনেশ্বরে যান। মঙ্গলবার হাওড়াগামী ট্রেন চালু হতে তাঁরা কলকাতা ফিরেছেন। অর্ক এ দিন বলছিলেন, “ভুবনেশ্বরেও ঘরে আলো ছিল না। বাজারে আগুন দর। আলু ৪০ টাকা।”
পুরীতে পর্যটকেরা বেঁচে যাওয়ায় আমজনতার জল্পনায় মহিমা বেড়েছে স্বয়ং জগন্নাথ দেবের। ১৩ বছর আগের সুপার সাইক্লোনেও পুরী কার্যত অক্ষত ছিল। এ বার পুরীর জেলাশাসকের বাংলো গাছ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরের কল্পবৃক্ষের ডালপালা ভেঙেছে। এই বটের তলায় শ্রীচৈতন্য সাধনা করেছিলেন বলে কথিত। মন্দির-চত্বরে যেখানে দীন-দরিদ্রকে অন্নদান করা হয়, সেই আনন্দবাজারের বুড়ো বটগাছও উপড়ে গিয়েছে।
বিপদের আবহেও ছড়াচ্ছে নানা গালগল্প। এক দল পর্যটক আলোচনা করছিলেন, রাতে অন্ধকারেও জগন্নাথ মন্দিরের উপরে কীসের আলো দেখা গিয়েছে! এক প্রবীণ গম্ভীর মুখে রায় দিলেন, রাতে যাতে অসুবিধে না-হয়, গুজরাত থেকে নরেন্দ্র মোদী এই আলোর ব্যবস্থা করেছেন। শুনে হেসে ফেললেন পুরীর এসপি অনুপকুমার সাহু। বললেন, “বিপদের সময়ে এ সব গুজব কারা যে ছড়ায়!” পুলিশকর্তার ওই হাসিতেই বড় রকমের বিপর্যয় থেকে রেহাই মেলার স্বস্তি ফুটে উঠছিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.