হাতে সময় মোটে ৩৬ ঘণ্টা, ওড়িশা বাঁচাল নবীন প্রশাসন
স্তাদের মার দুই রাতে!
বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা অতি-প্রবল ঘূর্ণিঝড় পিলিনের হাত থেকে রাজ্যবাসীকে রক্ষা করতে কার্যত ৩৬ ঘণ্টা বা এক দিন-দুই রাত্রি সময় পেয়েছিল নবীন পট্টনায়কের প্রশাসন। আর সেই সময়কে কাজে লাগিয়েই রক্ষা পেল ওড়িশা। ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোন তো বটেই, ২০০৯ সালে বাংলায় আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় আয়লার ক্ষেত্রেও এমন উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি।
পনেরো বছর আগে এমনই এক অক্টোবরের দিনে সুপার সাইক্লোনে ধুয়েমুছে গিয়েছিল ওড়িশার সমুদ্রসংলগ্ন এলাকা। মৃত্যু হয়েছিল অন্তত দশ হাজার মানুষের। এ বছর পিলিনের আছড়ে পড়ার সময়টাও সেই অক্টোবর। এলাকাও প্রায় এক: তটবর্তী ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশ। এর মধ্যে নবীনের রাজ্যের উপর দিয়েই বেশি ঝড়ঝাপটা গিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা পনেরো বছর আগের ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায় নেহাতই সামান্য।
কী সেই জাদু, যা এই ৩৬ ঘণ্টায় দেখিয়েছে নবীন পট্টনায়ক প্রশাসন? এবং কার সাহায্যে তারা এই সুযোগ পেয়েছিল?
পিলিনের পরেও দমানো যায়নি উৎসাহী পর্যটকদের।
প্রথম কৃতিত্বটা অবশ্যই মৌসম ভবন তথা আবহবিজ্ঞানীদের। সেটা ওড়িশার প্রশাসনের একাংশও মেনে নিচ্ছে। ঝড়ের জন্ম থেকে তার গতিপথ, কখন কোথায় সেই ঝড় ভারতীয় উপকূলে ধাক্কা খাবে এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য তারাই জুগিয়েছিল। মহালয়ার দিন থেকেই বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ দানা বাঁধার আশঙ্কা করেছিলেন আবহবিজ্ঞানীরা। ৯ অক্টোবর রাতে সেই নিম্নচাপ শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়। মৌসম ভবন জানায়, ১২ অক্টোবর, অষ্টমীর রাতে ওই ঘূর্ণিঝড় শক্তি বাড়িয়ে ওড়িশা-অন্ধ্রপ্রদেশ সীমানায় আছড়ে পড়বে। এর পর থেকেই শুরু হয় ওড়িশা প্রশাসনের তৎপরতা।
ওড়িশার সরকারি অফিসারেরা জানিয়েছেন, ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনের ভয়াবহ স্মৃতিকে মাথায় রেখেই শুরু হয় ত্রাণ ও রক্ষার কাজের পরিকল্পনা। প্রথমে ১৪টি জেলাকে বিপজ্জনক ঘোষণা করা হয়। বৈঠকে ডাকা হয় জেলাশাসক, পুলিশ, ত্রাণ দফতর ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্তাদের। সেনা-সাহায্য চেয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিকে চিঠি পাঠান মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক।
কেমন উদ্ধার ব্যবস্থা রেখেছিল ওড়িশা প্রশাসন? সরকারি সূত্রে খবর, প্রথমত, সমুদ্র সংলগ্ন পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা ছিল অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র। এখান থেকে যত বেশি সম্ভব মানুষকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, এই এলাকা পার হয়েই যে নিচু অঞ্চল রয়েছে, খালি করা হয় সেই সব জায়গাও। তৃতীয়ত, নিচু এলাকা প্লাবিত হলে উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স বা এনডিআরএফ-এর দল মোতায়েন রাখার ব্যবস্থাও হয়। এ ছাড়াও পুরীতে পর্যটকদের সতর্ক করা হয়।
যথাসময় আবহবিজ্ঞানীদের হিসেব নিখুঁত ভাবে মেনে পিলিন অষ্টমীর রাতে আছড়ে পড়েছে ওড়িশার খুব কাছে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলামে।
ঝড়ে বিধ্বস্ত ভুবনেশ্বরের পুজোমণ্ডপ।
পুরীর পুলিশ সুপার অনুপকুমার সাহু বলছেন, “ঝড়ের পূর্বাভাস মিলে যাওয়ায় উদ্ধার কাজ চালানো অনেক সহজ হয়েছে। ১৯৯৯ সালের মতো মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি।” ঘটনাচক্রে, আবহাওয়া দফতরের এই সাফল্যের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ১৯৯৯ সালের ব্যর্থতার মধ্যেই। এক প্রবীণ আবহবিজ্ঞানী জানান, সে সময় উন্নত যন্ত্রপাতির বদলে কাগজে-কলমে হিসেব করে পূর্বাভাস দিতেন তাঁরা। এখন প্রায় সবটাই যন্ত্রনির্ভর। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের এক কর্তা জানান, সুপার সাইক্লোনের পর আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে কেন্দ্র। বিশাখাপত্তনমে ঘূর্ণিঝড় নজরদারি ও সতর্কতা কেন্দ্র-সহ বিভিন্ন রাজ্যের আবহাওয়া অফিসে ডপলার রেডার, জিপিএস প্রযুক্তি-সহ নানা যন্ত্রপাতি বসানো হয়।
বদল এসেছে আবহবিজ্ঞানীদের গাণিতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতেও। আগে একটি বা দু’টি পদ্ধতি দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্র মাপা হত। এখন সেখানে চার-পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, “আবহবিজ্ঞানীদের গাণিতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি উন্নত হয়েছে। প্রতিটি ঝড়ের পর সেই তথ্যও গাণিতিক পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হচ্ছে।”
তবে আবহবিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, সময়ের সঙ্গে বিজ্ঞানের উন্নতি তো হবেই, কিন্তু পূর্বাভাস মেলার পর থেকে ওড়িশা প্রশাসন যে ভাবে কাজ করেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। মৌসম ভবনের এক আবহবিদ বলেন, “নিয়মিত আমাদের সঙ্গেও সমন্বয় রেখেছিল ওড়িশা।”
কোনও মতে চলছে যাতায়াত।
ওড়িশার এক সরকারি মুখপাত্র বলছেন, পূর্বাভাস ৩৬ ঘণ্টা ধরে টানা সতর্কবার্তা প্রচার করা হয়েছিল। মৃত্যু এড়াতে প্রথমে সমুদ্র থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার বাসিন্দাদের ত্রাণ শিবিরে সরানো হয়। মৎস্যজীবীদের বসতিগুলি খালি করে দেয় প্রশাসন। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি রেল স্টেশন এলাকাতেও ত্রাণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ওড়িশার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ন’লক্ষ মানুষকে সরানো হয়েছে। যদিও সরকারি কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, বেশির ভাগই দূরে আত্মীয়দের বাড়ি চলে যান। সরকারি ত্রাণ শিবিরেও অনেকে ঠাঁই পেয়েছেন। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা জানান, শিবিরে যত লোক রাখার জায়গা ছিল, প্রাণ বাঁচাতে তার চেয়ে বেশি লোক রাখা হয়েছে।
ঝড়ে বিপর্যন্ত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্গঠনের কাজেও কিন্তু ভাল ফল করেছে নবীন প্রশাসন। শনিবার রাতের ঝড়ে ভুবনেশ্বর, পুরী, গোপালপুর, ব্রহ্মপুরে প্রচুর গাছ উপড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। রবিবার ভোর হতেই বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনকে রাস্তা খোলার কাজে লাগানো হয়। এর জন্য তাঁদের হাতে হাতে মজুরিও মিলেছে। ওড়িশার এক পুলিশকর্তা জানান, বায়ুসেনা ও নৌবাহিনী-সহ সেনাবাহিনীর একটি দল এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর একটি দলকেও তৈরি রাখা হয়।
এই সাফল্য নিয়ে অবশ্য পাল্টা দাবিও রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার নবীন প্রশাসনকে পুরো কৃতিত্ব দিতে নারাজ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডির দাবি, ইউপিএ আমলে একাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়াতেই আবহাওয়া দফতরের এই আধুনিকীকরণ হয়েছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, নবীনকে পুরো কৃতিত্ব দিচ্ছেন না ওড়িশাবাসীও! তাঁরা বলছেন, বিজ্ঞান যেমন সাহায্য করেছে নবীনকে, তেমনই তাঁর সহায় ছিলেন জগন্নাথদেবও। এক পুলিশকর্তা যেমন উদাহরণ দিলেন চিলিকা হ্রদের দু’টি দ্বীপের। সেই দুই দ্বীপ মিলিয়ে হাজার দশেক মানুষের বাস। তাঁদের উদ্ধার করা যায়নি। “বাধ্য হয়ে জগন্নাথদেবের হাতেই সঁপে দিয়েছিলাম ওঁদের ভাগ্য।” ঝড়ের পরেও নিরাপদই তাঁরা!

পুরীতে রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.