ভারী গাড়িটাও দুলছে যেন নৌকো
ঝড়ের ডায়েরি: পিলিন-পথে পাঁচ মূর্তি
পিলিনের আগমনী শুনতে শুনতেই পুজোয় ডুব দিয়েছিল কলকাতা। ছুটি পড়ে গিয়েছিল খবরের কাগজের দফতরেও। কিন্তু অষ্টমীর সকাল থেকে অঞ্জলির জটলায় প্রায় ঝড়ের বেগেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল খবরটা সাইক্লোন আসছে! টিভি চ্যানেলগুলো বারবার জানান দিচ্ছে, অষ্টমীর রাত আটটার পরই গোপালপুরের কাছে আছড়ে পড়বে পিলিন! কলকাতার আকাশেও কালো মেঘ, খেপে খেপে বৃষ্টি। তার মধ্যেই বার্তা সম্পাদকের ফোন “শোনো, ’৯৯-এর সুপার সাইক্লোনের কথা মনে আছে তো? ১০ হাজার লোক মারা গিয়েছিল। ছুটির কথা ভাবলে চলবে না। পত্রপাঠ বেরিয়ে পড়ো।”
তিন জন রিপোর্টার, দু’জন ফটোগ্রাফার। মোট পাঁচ। আর ড্রাইভার। তৈরি হয়ে গেল টিম। সব ট্রেন বাতিল, ফলে জাতীয় সড়কই ভরসা। ঝড়ের রাতে মোদের অভিযান।
ঝলমলে আলোয় সেজে গোটা বাংলা যখন অষ্টমীর রাত জাগার তোড়জোড়ে ব্যস্ত, আনন্দবাজারের গাড়ি ছুটল সাগর-ঝড়ের মোলাকাতে।
কোলাঘাটের ধাবায় ছোট্ট একটা বিরতি। কফির কাপে চুমুক। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি চলছেই। সঙ্গে বাড়ছে হাওয়ার দাপট। রূপনারায়ণের জল উথালপাথাল। ধাবার চেয়ার-টেবিল উল্টে পড়ে যাচ্ছে। দ্রুত সে সব গুটিয়ে ঘরে তুললেন দোকানি। এর পরে আর কী জুটবে কে জানে? জল আর পর্যাপ্ত শুকনো খাবার কিনে নেওয়া গেল। ঠিক হল, যতটা পারা যায় এগিয়ে থাকব। টেলিফোনে বার্তা সম্পাদক বলে দিলেন, রাতে বৃষ্টি বাড়লে গাড়ি চালানোর ঝুঁকি নেবে কি না, ভেবে দেখো। তেমন হলে কোনও হোটেলে থেকে যেও।
মুম্বই রোড অর্থাৎ ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ছেড়ে গাড়ি বাঁক নিল চেন্নাইমুখী ৫ নম্বর জাতীয় সড়কে। খড়্গপুর তখন প্রবল বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে দাপুটে ঝড়। গাছপালা দুলছে প্রবল ভাবে। বিপদ বুঝে পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে সারি সারি ট্রাক। টেলিফোনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল এখনও স্থলভূমি থেকে খানিকটা দূরে ‘পিলিন’। সাগরে থমকে দাঁড়িয়ে জলীয় বাষ্প টেনে নিজের শক্তি বাড়াচ্ছে। হাওয়ার গতি কত হবে এখন? যে যার মতো হিসেব করার চেষ্টা করছি আমরা।
পিলিনের তাণ্ডবে আটকে পড়া অ্যাম্বুল্যান্সকে পথ করে দিতে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয়রাই। ছবি: সুমন বল্লভ।
দাঁতন পেরিয়ে জলেশ্বর। গাড়ি ঢুকল ওড়িশায়। বৃষ্টির তোড় এখানে কিছুটা কম। গাড়ি এই গতিতে এগোলে সাড়ে ১০টার পরে বালেশ্বর পৌঁছব। ঠিক হল রাতে সেখানেই হোটেলে থাকা হবে। এসএমএস ঢুকল, পিলিন মাটি ছুঁয়েছে শ্রীকাকুলামে।
অন্ধকারের মধ্যেই বুঝতে পারছি, আশপাশে বেশ কিছু বড় বড় বাড়ি। তার মানে শহর। নির্ঘাৎ বালেশ্বর। কিন্তু বাড়িগুলো মিলিয়ে গেল একটু পরেই। এ কী! শহরে ঢুকব কখন? প্রবল বর্ষণ, সঙ্গে ঝড়। বড় জোর ফুট দশেক দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে। অবশেষে বোঝা গেল, শহরে ঢোকার একমাত্র বাঁকটি আমরা ভুল করে পেরিয়ে এসেছি। বাঁ হাতে এক তাল অন্ধকারের মতো পড়ে রয়েছে বালেশ্বর। মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সামনে সোরো।
বিদ্যুতের বালাই নেই। যে দিকে চোখ যায়, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। হঠাৎই তার মধ্যে ওটা কী?
আলো না? ঠিক দেখছি তো? নাকি মনোজ বসুর গল্পের কোনও অশরীরী চরিত্র উঠে এল সামনে? রহস্য ভেদ হল আর একটু এগিয়ে। আরে, এ তো একটা ধাবা! ভাবা যায়? জেনারেটরে আলো জ্বালিয়ে টিভিতে চোখ রেখে বসে আছেন ধাবামালিক যোগিন্দর।
খানা মিলেগা?
সির্ফ রোটি-মোরগা।
যোগিন্দর জানালেন, কোত্থাও কোনও হোটেল মিলবে না। এই দুর্যোগে প্রাণ বাঁচবে কিনা ঠিক নেই, কে হোটেল খুলবে? সোরোয় তো নয়ই, দেখুন জাজপুরে কিছু খোলা কি না! প্রাণভয়ের চেয়ে বড় কিছু নেই!
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যেই আচমকা থামতে হল। গাছের ডাল পড়ে রাস্তা বন্ধ। আশেপাশের কোনও বাড়ির খড়ের চাল বেঁচে নেই। রাস্তায় ছড়িয়ে গিয়েছে সেই খড়। ধাবা থেকে গাড়ি ছাড়ার পর সোরো পেরিয়েছে, জাজপুর গিয়েছে। কোথাও হোটেল পাইনি। শহরে ঢুকেও মানুষজন চোখে পড়েনি। সব খাঁ খাঁ। ডাকলেও কেউ সাড়া দেয়নি। অন্ধকারে ভদ্রক পেরিয়ে একটা হোটেলে একটু আলো চোখে পড়ায় নামা হয়েছিল। কেউ এক জন দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল। অনেক ডাকাডাকির পরে জবাব এল রুম নেহি হ্যায়।
কটক। ফের শুরু হল হোটেলের খোঁজ। সবই তো বন্ধ। রাস্তায় পাশে থানা। তার দরজাতেও বিশাল তালা। নেড়েচেড়েও লাভ হল না। ভেতরে কেউ নেই। প্রাণ বাঁচাতে পুলিশও বেপাত্তা। মহানদীর সেতুর উপরে দেখে এসেছি একটা গাড়ি, রেলিঙে ধাক্কা মেরে মুখ থুবড়ে পড়ে। আমাদের ভাগ্যে কী আছে? সামনে উদয় হলেন খেটো ধুতি পরা এক জন। গামছায় মুখ ঢাকা। হোটেলের দিশা চাইতে খিলখিল করে হাসতে লাগলেন। আকাশের দিকে আঙুল তুলে ওড়িয়া ভাষায় বললেন সব ধ্বংস হয়ে যাবে। পালাও পালাও!
গন্ধে মালুম, নেশাখোর।
গতিবেগ
১৯৯৯ সুপার সাইক্লোন ওড়িশা ২৬০কিমি/ঘণ্টা
২০০৫ হ্যারিকেন ক্যাটরিনা আমেরিকা ২৮০কিমি/ঘণ্টা
২০১৩ সাইক্লোন পিলিন ওড়িশা ২১৫কিমি/ঘণ্টা
জাতীয় সড়কের উপরেই জায়গায় জায়গায় জল জমে। সঙ্গে ঝড়ের ধাক্কা। বেশ কয়েক বার পিছলে গেল গাড়ি। রাস্তার পাশে হিলহিলে গাছগুলো দুলছে। ঢোকা হল ভুবনেশ্বরে। তেল নিতে হবে। কোথায় কী? সব পাম্প বন্ধ। একটা হোটেলের বাইরে আলো। ধাক্কা দিয়েও সাড়া মিলল না। উল্টো দিকে একটা পুজোমণ্ডপের কাপড় উড়ে গিয়েছে। দুর্গা একা দাঁড়িয়ে ভিজছেন। একটু এগিয়ে আর একটা হোটেল। কাচের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভেতরে কেউ শুয়ে। দরজায় ধাক্কা দিতে দৌড়ে আসতেই মেঝের জলে একসঙ্গে দু’পা পিছলে সজোরে আছাড়। তিনি পড়েই রইলেন, আর এক জন এসে দরজা খুললেন। ঘর মিলবে, তবে এক ঘণ্টা পরে। ঝড়ের জন্য সব তুলে দেওয়া হয়েছে। ভাড়া? ছ’হাজার টাকা।
নাহ্ থাক! চলো পুরী। সেখানে নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।
রাস্তা বন্ধ। আর এগোনো যাবে না। অন্ধকার ফুঁড়ে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটে বেশ কিছু ক্ষণ চোখ সইয়ে ঠাওর হল, একটা নয় দু’দুটো বিশাল গাছ। মোটা মোটা গুঁড়ি। আড়াআড়ি সটান শুয়ে রাস্তার ওপরে। বৃষ্টির কোনও ফোঁটা আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কে যেন বালতি ভর্তি জল ঢেলে যাচ্ছে উইন্ডস্ক্রিনে, অবিরাম। কাচ একটু নামাতেই যেন দানবের গর্জন। ঝড়ের দাপটে নৌকোর মতো দুলে উঠল ভারী গাড়ি। দ্রুত কাচ তুলে দেওয়া হল ফের। বাকি রাতটুকু এই বন্ধ গাড়িতেই কাটাতে হবে।
সেটাও কি নিরাপদ? গাড়িটাকে ধরে তখন বেমালুম ঝাঁকাচ্ছে ‘পিলিন’। বাঁ দিকে খুব কাছেই কোথাও সাগর। এই যদি ঝড়ের মার হয়, যে-কোনও সময়ে জলোচ্ছ্বাসের তোড় এসে গাড়িকে ভাসিয়ে দেবে না তো! তার চেয়ে ৪০ কিলোমিটার পিছিয়ে ভুবনেশ্বরে ফেরা যায় না?
না সাফ জানিয়ে দিলেন চালক শঙ্করবাবু। নিরুত্তাপ মানুষ। বৃষ্টি-ভেজা সড়কে ঝড়ের দাপটে বারে বারে পিছলে গিয়েছে ছুটন্ত গাড়ি, অক্লেশে সামলে নিয়েছেন। ভাঁজ পড়েনি কপালে। সেই তিনি বেঁকে বসছেন? ভয় পেয়ে গেলেন নাকি শঙ্করদা! এই দুর্যোগে এমন দরাজ হাসতে পারেন খুব কম মানুষই। ড্যাশবোর্ডে চোখ রেখে দু’বার অ্যাক্সিলারেটর দাবিয়ে শঙ্করবাবু জানালেন ভুবনেশ্বর ফেরার মতো তেল নেই গাড়িতে।
গাড়ির জানলায় জোরালো টোকা। ঘুম ভেঙে গেল। হালকা আলো ফুটেছে। ছাতা মাথায় অন্য এক সংবাদমাধ্যমের পরিচিত মুখ। জানা গেল তাঁর গাড়িও রাত থেকে আটকে। দু’একটা কথা বলতে না-বলতেই কুড়ুল হাতে কিছু লোক। গাছ কাটা হবে। কুড়ুল দিয়ে এই প্রকাণ্ড গুঁড়ি কাটতে তো রাত হয়ে যাবে! তাঁরা জানালেন বুলডোজার আসছে।
বুলডোজার হাজির। বৃষ্টি ধরেছে। কমেছে হাওয়ার জোরও। এ বার রওনা হব। সেই সময়েই হাজির পুলিশের একটি গাড়ি। খাকি উর্দি ভাবলেশহীন গলায় জানাল, পুরীর রাস্তায় আরও অন্তত এক ডজন গাছ পড়ে রয়েছে।
পরপর আট বার ঠেকে চন্দনপুর। এ বার বিশাল একটি বটগাছ রাস্তা জুড়ে। এর মধ্যে স্থানীয় লোকেদের কথা শুনে গ্রামের অন্য রাস্তা ধরে বেরোনোর চেষ্টা হয়েছে তিন বার। প্রতি বারই কোথাও গাছ, কোথাও বা ল্যাম্পপোস্ট আটকে দিয়েছে। পুরী মাত্র ১০ কিলোমিটার। মাঝখানে কাকুতিমিনতি করে একটা পাম্প খুলিয়ে গাড়িতে তেল ভরা হয়েছে। সকলে প্রাণপণে কাজ করছে, বটগাছ আর সরে না। একটা অ্যাম্বুল্যান্সও এসে আটকেছে।
বৈদ্যুতিক করাত আসায় কাজের গতি বেড়েছে। গাছের মাঝখানটা কোনও মতে সরিয়ে গাড়ি যাওয়ার জায়গা বার করা হয়েছে। আমরা পুরীর দিকে রওনা হলাম।
সাগর তীরের সমান্তরাল গাড়ির রাস্তায় এক ফুট পুরু বালি। বুলডোজারে বালি সরানো চলছে। গাড়ি থেকে নামামাত্র হাওয়ার ধাক্কায় টলে গেলাম। চোখে বিঁধল বালির ছররা। রাতের অভিসার শেষে পুরী। ১৪ কিলোমিটারের শেষ পথটুকু পেরোতেই লাগল সাড়ে ছয় ঘণ্টা!
সবই জগন্নাথের কৃপা!

প্রতিবেদন: অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.