আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গিয়েছে মালদহের সুলতানি আমলের মিষ্টি। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে হাতে গোনা যে কয়েকটি মিষ্টি এখনও রয়েছে, তাদেরও পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই। রসিকজনের কথায়, সেই সব মিষ্টিতে আর আগের মতো স্বাদ-গন্ধ পাওয়া যায় না। প্রাচীন বাংলার রাজধানীর সেই প্রাচীন মিষ্টির কথা সে ভাবে চর্চিতও হয় না। তবু পুজোর মরসুমে এখনও সুলতানি আমলের রসকদম্ব, কানসার্টের চমচম, মনোহরা,ক্ষুরমা।
মালদহের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টির নাম ‘টাঁড়ার খাজা’। ১৬০০ খৃষ্টাব্দে বাংলার রাজধানী গৌড়ের শেষ সুলতান ছিলেন সুলেমান করবানি। করবানি বংশের সুলতানরা সেইসময় বাংলার রাজধানীকে গৌড় থেকে সরিয়ে পাশের টাঁড়া এলাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। শোনা যায়, সেই সময় জয়নগর থেকে এক মৌলবি টাঁড়ায় এসেছিলেন। তিনিই প্রথম খাজা তৈরি করেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। রাজধানীর নাম অনুসারে সেই খাজা, টাঁড়ার খাজা নামে খ্যাতি লাভ করেছিল। ময়দা ও ঘি দিয়ে তৈরি করে চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরি হতো সেই খাজা। জেলার ইতিহাসবিদ কমল বসাক বলেন, “এক সময় আমরা টাঁড়ার খাজা দিয়ে সকাল-বিকালে টিফিন করতাম। খাজা এতবড়ো ও সুস্বাদু ছিল যে দুধে ফেলে একটা খেলেই পেট ভরে যেত। এখন আর সেই খাজা আর নেই। তবে খাজা তৈরির কারিগরদের বংশধররা রয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁরাও আর খাজা তৈরি করেন না। |
মালদহের রসকদম্ব। —নিজস্ব চিত্র। |
‘মনক্কা’ নামের মিষ্টিটি দেখতে ছিল অনেকটা আঙুরের মতো। সেই মিষ্টিও এখন আর মালদহে চোখে পড়ে না। তবে সুলতানি আমলের মনোহরা মিষ্টি এখনও তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মহদিপুর এলাকায়। অনেকটা চেরি ফলের মত দেখতে লাল সাদা রংয়ের। বাইরে কলাইডালের পুর ভিতরে রস ভরা। মনোহরা মিষ্টিটি একবারে মুখে না পুড়লে রস ছলকে উঠতে পারে, সর্তক করে দিলেন কারিগররা। মহদিপুর ছাড়া এই মিষ্টি জেলার কোথাও এখন আর তৈরি হয় না। মাত্র পাঁচজন কারিগর এই মনোহরা মিষ্টি এখনও তৈরি করেছেন।
জনপ্রিয়তায় তুলনায় এগিয়ে রয়েছে মালদহের রসকদম্ব। কদম ফুলের মতো দেখতে এই মিষ্টির ভিতরে ছোট রসগোল্লা। তার উপরে থাকে ক্ষীরের মোটা প্রলেপ। সারা গায়ে জড়ানো পোস্ত মাখানো চিনি। পোস্তের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন রসকদম্বের গায়ে শুধুই চিনির দানা শোভা পায়।
জনশ্রুতি রয়েছে, সুলতান হুসেন শাহের আমলে চৈতন্যদেব গৌড়ে এসেছিলেন। গৌড়ের কেলিকদম্ব গাছের তলায় চৈতন্যদেব রূপ সনাতনকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেই কদম্ব গাছ থেকেই রসকদম্ব মিষ্টির সৃষ্টি। যদিও ঐতিহাসিকেরা তা মানতে চান না। তবে বৈষ্ণবদের কাছে রসকদম্ব মিষ্টি অমৃত সমান।
কানসার্টের চমচমও কিন্তু পিছিয়ে নেই। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় বর্তমান বাংলাদেশের কানসার্ট জেলা থেকে এক ঝাঁক মিষ্টির কারিগর এপার বাংলার মালদহে এসে ঘাঁটি গাড়ে। ওই বাংলাদেশের কানসার্ট জেলার কারিগররা প্রথম শুরু করে চমচম। সেই চমচম এখন কানসার্টের চমচম নামে পরিচিত। রসকদম্ব ও কানসার্টের মতো ক্ষুরমাও মালদহে রয়েছে।
একসময় মালদহ শহরের দুর্গাবাড়ি, ফুলবাড়ি এলাকা হালুয়াপট্টি মিষ্টির বাজার নামে বিখ্যাত ছিল। এখন সেই হালুয়াপট্টির মিষ্টির বাজার নেই। মিষ্টি রসিকদের সংশয় টাঁড়ার খাজার মতো সুলতানি আমলের শেষ মিষ্টি রসকদম্ব, মনোহরাও অচিরে হারিয়ে যাবে না তো! |