|
|
|
|
ভাঁজে ভাঁজে সুনীলের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
তরুণ কবিদের পদে পদে প্রশ্রয় দিতেন তিনি। ফলে ক্রাচ হাতে, লম্বা চুলের
কাকাবাবুকে দেখলে তাঁর আনন্দের অবধি থাকত না। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
মিশর রহস্য দেখলে যিনি সব চেয়ে খুশি হতেন, তিনি আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। এই ছবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত।
ছবিতে কাকাবাবু প্রথমেই ব্যাক-টু-ক্যামেরা। হানি আলকাদি (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) মরুভূমির ডেরায় বসে ডাকছেন, ‘ওয়েলকাম প্রফেসর।’ আর ক্যামেরার দিকে পিছন করে, হাতে ক্রাচ নিয়ে লোকটা এগিয়ে গেল। তার পর তাঁকে ক্যামেরা ধরল রাতের কলকাতায়। টপ শটে তখনও পুরো দেখা যাচ্ছে না, হ্যান্ডহেল্ড ক্রাচ নিয়ে পা ছড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডে বসে। সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে এসি বাস।
বাস এগোল। এবং ছবিও যত এগোল, ধরা পড়ল কাকাবাবু রাজা রায়চৌধুরী (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়)-র হরেক বৈশিষ্ট্য। আশির দশকে ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’র মতো নিপাট আঁচড়ানো কালো চুল নয়। মরচে-রঙা ডাই করা এলোমেলো লম্বা চুল। ছিমছাম চশমা। কিছুক্ষণ পরে বোঝা গেল, তিনি টুইটারেও আছেন। দিল্লিতে আল মামুন (রজিত কপূর)-এর দল তাঁর ওপর হামলা চালালে কাকাবাবুর টুইট: হ্যাড আ ব্লাস্ট।
এটাই সুনীল স্পিরিট! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম দিক ছিল, সমর্থক-বিরোধী নির্বিশেষে তরুণ প্রজন্মকে সাদর প্রশ্রয়। জীবনের শেষ দিকেও তরুণদের প্রশ্রয় দিতে নতুন করে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা চালু করেছেন, ষাটের দশকে ভাস্কর চক্রবর্তী, কবিরুল ইসলাম থেকে হাল আমলে সুবোধ, মল্লিকা এবং জয় গোস্বামী পেরিয়ে শ্রীজাত, বিনায়ক... নবীনদের জন্য তাঁর দরজা সব সময়েই ছিল অবারিত। এর পরও বলতে হবে, কাকাবাবুর নতুন রূপ তাঁর ভাল লাগত কি না!
সুনীলের পোশাক অবশ্য বদলাত না। সেই ট্রাউজার্স, হাফহাতা বুশশার্ট। বুকের বোতাম দুটো খোলা। নীরার প্রেমিক জানতেন, আধুনিকতা শুধু পোশাকে নয়। সে থাকে মেজাজে। ‘মিশর রহস্য’ উপন্যাসে টিন এজ প্রেমের হাল্কা ইঙ্গিত ছিল। সেখানেই প্রথম দেখা দিয়েছিল রিনি। পাড়ার মেয়ে কায়রো বিমানবন্দরে সন্তুকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী রে, কলকাতায় বললি না তো, এখানে আসবি।’ সন্তুর উত্তর: ‘আমরা কখন যে কোথায় যাব, ঠিক থাকে না। আজ কায়রো, পরশুই হয়তো মস্কো চলে যাব।’ পরে সন্তু-কাকাবাবুর আরও অনেক গল্পে এই কিশোরী কন্যাকে আমরা দেখেছি। এখানে রিনি (ত্রিধা) ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ে, দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়। ইংরেজিতে কথা বলে। সন্তু এবং কাকাবাবুর বাংলা সংলাপের পাশে রিনির ইংরেজি ছবিটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আচমকা মুমুর কথা মনে পড়েছে। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া সেই মেয়ে নীললোহিতকে ‘ব্লু আঙ্কল’ বলত, দিকশূন্যপুরে যাওয়ার বায়না ধরত। সিনেমায় সন্তু রিনিকে চুমু খেতে গেল। আর তখনই পকেটের মোবাইল বাজছে। চুমু শেষ না হলে কী আসে যায়? সন্তু বলতেই পারে, ‘এই হাত ছুঁয়েছে রিনির মুখ/এ হাতে কি আমি পাপ করতে পারি!’
এই ছবিতে কাকাবাবু গম্ভীর নন, উইটি। সন্তুর প্রেমে প্রশ্রয় দেন, চমৎকার রসিকতা করেন। সন্তুর আগ্রহ, কাকাবাবুর ঘরে অচেনা লোকটা কে! কাকাবাবুর উত্তর, ‘টমাস আলভা এডিসন। টুনি বাল্ব কী ভাবে বানাতে হয়, শেখাতে এসেছিল।’ আর এক জায়গায়, ‘শরদিন্দু আর মানিকবাবুই তোদের মাথাটা খেয়েছেন। সবাইকে গোয়েন্দা হতে হবে।’ এই সব রসিকতা কার লেখায় অবাধ যাতায়াত করত, বাঙালি জানে। সৃজিতের চিত্রনাট্যে কাকাবাবু সাহস এবং রসবোধের মিশেল। মরুভূমিতে হানি আলকাদির ডেরায় ভিলেনরা পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁকে নিয়ে এলে বলেন, ‘এখানে এ ভাবে নেমন্তন্ন করা হয় নাকি?’ মৃত্যুর মুখে ঘাবড়ে না গিয়ে এই রকম রসিকতাও ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। চিলিকায় সুনীলের নৌকো এক বার ডুবে যাচ্ছিল। তখন অনুভূতি কেমন হয়েছিল জানতে চাইলে সহাস্য উত্তর দিতেন, ‘কিছু না। একটাই টেনশন হচ্ছিল। বুক পকেটে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা ভিজে যাবে।’ সৃজিতের চিত্রনাট্য রিনির সঙ্গে মুমুকে, আর কাকাবাবুর সঙ্গে সুনীলকে মিশিয়ে ছবিটাকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। |
|
ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, ১৯৮৪ সালের গল্পটাকে হাল আমলের মিশরে হোসনি মোবারক-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাকার করে দেওয়া। সুনীলের গল্পে ছিল, হানি আলকাদি (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) তাঁবুতে বসে শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ পড়ে। দেশের মানুষকে মুক্তি দিতে বিপ্লবী দল তৈরি করতে চায়। এখানে সৃজিত দেখান, কাকাবাবু সাহায্য করে এসেছিলেন বলেই তাহরির স্কোয়ারে বিদ্রোহ ঘটাতে পারল হানি আলকাদি। মূল উপন্যাসে ছিল না, কিন্তু এখানে আলকাদি কাতর স্বরে কাকাবাবুকে অনুরোধ করে, ‘আমাদের ডেমোক্র্যাসি ভিক্ষা দেবে?’ হোসনি মোবারকের দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের দুর্দশায় ফুঁসে ওঠে সে। কাকাবাবুকে অভিবাদন জানায়, ‘কমরেড, ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’ তাঁর প্রথম বড় উপন্যাস ‘একা এবং কয়েকজন’-এ এসেছিল বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসের সিদ্ধার্থ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘আমি ফিরে আসব। তার পর সবাইকে মেশিনগানের সামনে ফেলে র্যাট ট্র্যাট ট্যাট ট্র্যাট।’ কাকাবাবুর সংলাপ: ‘বিপ্লবের পরও তুমি হানি আলকাদি হয়েই থেকো। ভারতীয় নেতাদের মতো হয়ে যেও না।’ সেই সংলাপের আগে ছবির প্রথমার্ধে সৌমিক হালদারের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল দিল্লির জেএনইউ ক্যাম্পাসে সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর ছাত্রসংগঠন ‘আইসা’র বিশাল দেওয়াল লিখন। ‘সেই সময়’ বা ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর লেখক এটাই চাইতেন। পুনরাবৃত্তি নয়, ইতিহাসের রি-ইন্টারপ্রিটেশন।
সৃজিতের এই সুনীল-ট্রিবিউটে বুদ্ধিমত্তা প্রবল! কাকাবাবু প্রসেনজিৎকে দিয়ে অ্যাকশন-দৃশ্য নয়। বরং পরদায় তখন কমিক স্ট্রিপের মতো আঁকা সুপারইম্পোজ হয় উপন্যাসের ওই লাইনগুলিতে: ‘কাকাবাবুর চোয়াল কঠিন হয়ে উঠল। চোখে জ্বলে উঠল আগুন।’ একই সঙ্গে বইয়ের পৃষ্ঠা, কমিক্স ও ক্যামেরা মিলেমিশে চলচ্চিত্র মাধ্যমটি আদৌ কত দূর এগোল, প্রসেনজিৎকে অ্যাকশন-দৃশ্য মানাবে না ভেবেই ঘটনাটা করা হল কি না এ সব যাঁরা বিশ্লেষণ করতে চান, করবেন। কিন্তু কমিক্সকে ট্রিবিউট দেওয়া ছিল সুনীলের উপন্যাসেই। হিয়ারোগ্লিফিক্স মানে যে প্রাচীন মিশরের চিত্রভাষা, সেটা সন্তু বলে দেওয়ার পর কাকাবাবুর কথা, “তা হলে তো কমিক্সগুলিকে যত খারাপ ভাবতাম, ততটা নয়।” সৃজিতের উপস্থাপনায় বাদ গেল না সেই কমিক্সও।
সৌমিকের ক্যামেরা মরুভূমিতে কথা বলেছে। ধু ধু বালিয়াড়িতে একাকী জিপ, বালির ঝড় বা পিরামিডের নীচে নামার দৃশ্যগুলি চমৎকার। ‘দিল্লি দিল্লি’ গানের সঙ্গে মেহরৌলি, জাম্মা মসজিদের পুরনো দিল্লি, কাবাবের দোকান, জেএনইউ ক্যাম্পাস...একেবারে অন্য ছবি। মরুভূমিতে উটের দৌড়ের দৃশ্যে যেন সত্যজিতের সোনার কেল্লার প্রতিও শ্রদ্ধার্ঘ্য। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুরে সেখানে শোনা গিয়েছে রাবাব, চারঙ্গ, আর সাজ। এমনকী অজপা মুখোপাধ্যায়ের স্টাইলিং যে ভাবে কাকাবাবু, সন্তুদের পাশাপাশি বিভিন্ন বেশে হানি আলকাদি এবং আল মামুনকে ধরেছে, প্রশংসা করতেই হয়।
এর পরও তিনি খুশি হতেন না? গত এক বছরে তাঁকে নিয়ে অজস্র স্মৃতিচারণ এবং চর্বিতচর্বণ হয়েছে। কিন্তু লেখককে শ্রদ্ধার্ঘ্য মানে শুধু তাঁর সঙ্গে কয়েক পেগ টানার গল্প নয়। তাঁর লেখা বিশ্লেষণ করা, চরিত্রগুলিকে অটুট রেখে প্রয়োজনে তাঁর অন্য লেখার সঙ্গে আদানপ্রদান (কবিরা তো সারা জীবনে একটিই লেখা লেখেন), তাঁর বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই অন্য মাধ্যমে রূপান্তর। এই ছবি তাই সুনীলের প্রতি অন্যতম সেরা শ্রদ্ধার্ঘ্য।
তবু দুই নম্বর কাটতে হল। এক, সৃজিতের সুভাষ ঘাই-প্রীতি। সংলাপে সুভাষ ঘাই, এমনকী একটি দৃশ্যে নিজে সুভাষ ঘাইয়ের মতো অভিনয়ও করলেন। দুই, রাজেশ শর্মা দরজায় টোকা মারার পর স্বস্তিকা, নীলের বটি-সসপ্যান-কড়াই নিয়ে দরজা আগলানো। ওখানে কমেডি নেই, রয়েছে ভাঁড়ামি। স্বচ্ছন্দে এডিট করা যেত। তবু লেটার মার্কস। দশে আট।
আর আসল প্রশ্নটা? প্রসেনজিৎ না ইন্দ্রনীল, কে বেশি ভাল? লেখক নির্ঘাত সিগারেট ধরিয়ে হেসে উঠতেন, ‘দুর! ও ভাবে বলা যায়? আমার তো সবাইকেই সমান ভাল লাগল।’
সহাস্য মুখটা এখনও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি! |
|
|
|
|
|