|
|
|
|
বড়জোর মেরে ফেলবে, আর কী
বিতর্কিত আইনজ্ঞ শাহিদ আজমি। খুন হয়েছিলেন বত্রিশ বছরেই। তাঁর জীবন নিয়ে
হনসল মেহতার হিন্দি ছবি ‘শাহিদ’। যা দেখতে চান না শাহিদের ‘আম্মি’। আর যা দেখে শাহিদের
ছোট ভাই খালিদ মুখ খুললেন আনন্দplus-এর কাছে। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
মাত্র ৩২ বছর বয়সে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর বুক। ভারতীয় চলচ্চিত্রে যে-ক’টি জীবনীমূলক সিনেমা বানানো হয়েছে, তাদের অধিকাংশ মুখ্য চরিত্র এত কমবয়সি নয়। তবে শাহিদ আজমি ছিলেন প্রথম থেকেই ব্যতিক্রমী। স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন তরোয়াল হাতে এক ফ্যানাটিক তাঁর দিকে ধেয়ে এসেছিল। সেটা ছিল ১৯৯২ সাল। তার পর থেকেই শাহিদের জীবনটা নাকি পালটে যায়। ষোলো বছর বয়সে চলে যান কাশ্মীর। বন্দুক তুলে নেন। তবে উগ্রপন্থীদের মতাদর্শের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। বাড়ি ফিরে আসার পরে, ১৯৯৪ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বলা হয় যে, তিনি নাকি ষড়যন্ত্র করেছিলেন দেশের এক বড় রাজনীতিবিদকে খুন করার জন্য। তাঁর বিরুদ্ধে একমাত্র প্রমাণ ছিল এক স্বীকারোক্তি। যেটা নাকি তিনি আদৌ দেননি। তবু পাঁচ বছর তিহাড় জেলে কাটাতে হয় তাঁকে। সেখানে থাকাকালীন তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। ২০০১ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। কিছু দিন আইনজ্ঞ মাজিদ মেমনের সঙ্গে কাজ করার পরে নিজে আলাদা ভাবে কাজ করা শুরু করেন। একটাই শর্ত। বেশির ভাগ গরিব ক্লায়েন্টের থেকে এক পয়সাও নিতেন না তিনি। খুনের হুমকি থাকা সত্ত্বেও ভুল ভাবে উগ্রপন্থী হিসেবে যারা চিহ্নিত হয়ে বছরের পর বছর জেলে আটকে থাকতেন, তাঁদের অনেকের কেস লড়েছেন তিনি। ২৬/১১ মুম্বই আক্রমণে অভিযুক্ত ফাহিম আনসারি-র কেস লড়ার সময় একদিন তাঁর অফিসে চার জন বন্দুকধারী পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করেন তাঁকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। |
‘শাহিদ’য়ে রাজ কুমার |
আর এই শাহিদের জীবন অবলম্বনে পরিচালক হানসল মেহতা তৈরি করেছেন হিন্দি বায়োপিক। নাম রেখেছেন ‘শাহিদ’। মুখ্য ভূমিকায় ‘এলএসডি’ ও ‘কাই পো ছে’ খ্যাত রাজ কুমার। আমির খান ছবির ট্রেলার আর প্রোমো দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। রাজ কুমারের কাজেরও তারিফ করেছেন তিনি। সিনেমাটি টরন্টো আন্তর্জাতিক ফিল্ম উৎসবে সমাদৃতও হয়েছে। তবু শাহিদের মা আর বড় দাদা ছবিটি আর দেখতে চান না। “আমার স্ক্রিপ্ট রাইটার আর আমার ছেলেকে প্রথমে পাঠিয়ে ছিলাম শাহিদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। ছবি বানানোর অনুমতি পাই। কিন্তু বড় পর্দায় আবার সেই ট্রাজেডি দেখতে চাননি তাঁরা,” বলছেন হনসল।
তবে শাহিদের ছোট ভাই, খালিদ আজমি, সিনেমাটি দেখেছেন। শাহিদ নিজে যে যে কেসগুলো শেষ করতে পারেননি, সেগুলো খালিদ শেষ করেছেন। “সিনেমাটা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, যেন আমি আমার কুড়ি বছর বয়সে ফিরে গেলাম। দুঃসাহসিক একটা ফিল্ম বানিয়েছেন হনসল স্যর,” বলছেন খালিদ।
হনসলের আগে দু’জন পরিচালক শাহিদের গল্প নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিবার রাজি হয়নি। “শাহিদের জীবন নিয়ে কিছু বানানো হলে, সেটা সিনেমায় হবে। ডকুমেন্টারি নয়। তবে মশালা সিনেমা হলে চলবে না। আম্মি বলেছিলেন ছবিতে যেন কোনও গান না থাকে। হনসল স্যর আমাদের অনুরোধ রেখেছেন,” বলেন খালিদ।
ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া সে অর্থে কোনও গান নেই। টাইটেল ট্র্যাকে রয়েছে অরিজিৎ সিংহের একটি গান। আর মাঝে মধ্যে কিছু সরগম আর নিঃস্তব্ধতা। গায়ে কাঁটা দেয়, যখন জেলে নগ্ন অবস্থায় রাজ কুমারকে অত্যাচারের দৃশ্যগুলো ফুটে ওঠে বড় পরদায়। বা যখন মুখে কালি লেপে দেওয়া হয় তাঁর। “চোখের জল আটকাতে পারছিলাম না। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। এক একটা ঘটনা পরদায় দেখানো হচ্ছে আর আমার সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। জানেন, দাদাকে আমার বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করে। কিন্তু বলা হয়েছিল যে, দাদাকে দিল্লির একটা বাজার থেকে অ্যারেস্ট করা হয়!” খালিদ জানান। |
হনসল মেহতা |
খালিদ আজমি |
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
যে দিন শাহিদ তিহাড় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফেরেন, সে দিন খালিদ নিজে সদর দরজা খুলে দিয়েছিলেন। “বাড়ি ফেরার পরেই আমাকে বলেন ল’ আর জার্নালিজমের কোর্সের ফর্ম নিয়ে আসতে। তার পর একটা পোর্টালে চাকরি করেন। কিছু দিন সেখানে কাজ করার পরেই শুরু করেন নিজস্ব আইন প্র্যাকটিস,” খালিদ জানান। একের পর এক কেস লড়েন শাহিদ। কিন্তু তার মধ্যেও লোকে তাঁকে কথা বলতে ছাড়েনি। সিনেমাতে যে ভাবে শাহিদের অতীত নিয়ে আইনজীবীরাও কটাক্ষ করেছিলেন, সেটাও কি বাস্তবে হয়েছিল? “হ্যাঁ। কাউকে কথা বলা থেকে বিরত করা সম্ভব নয়। ইউ কান্ট হোল্ড এনিবডি’স টাঙ্গ। তবে এটা জানি যে, আজও শাহিদভাই খুব ভাল আইনজীবী হিসেবেই পরিচিত। সাত বছর প্র্যাকটিস করে সতেরোটা অ্যাকুইটাল করিয়েছিল। এই ট্র্যাক রেকর্ড খুব কম দেখা যায়।”
ভয় করেনি যখন শাহিদ মারা যাওয়ার পর নিজে আবার কেসগুলো লড়তে শুরু করেন? এক বারও মনে হয়নি যে, বড় বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলছেন? “আমার আর হারানোর কিছু নেই। কী আর করবে আমাকে? না-হয় মেরেই ফেলবে। আর কী? যখন শাহিদভাই মারা যান, তখন আমি মুষড়ে পড়েছিলাম। আম্মি তখন বোঝান যে, আজও কত নির্দোষ মানুষ জেলে পড়ে রয়েছে। শাহিদ না থাকলেও আমাকে তাদের হয়ে লড়তেই হবে। আম্মির কথা মতই আমি কেসগুলো লড়তে শুরু করি,” বলেন খালিদ।
তবে একটা আক্ষেপ রয়েছে। শাহিদের স্ত্রী মারিয়াম-য়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে চান তিনি। সিনেমাতে রয়েছে মারিয়াম শাহিদকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন এই ধরনের কেস না লড়তে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে চলেও গিয়েছিলেন মারিয়াম। “আমি মারিয়ামের অবস্থা বুঝি। শাহিদ মারা যাওয়ার পরে একবার ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল ফোনে। ও আসতে চেয়েছিল। কিন্তু কোনও কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। সিনেমা শুরুর আগে হানসল স্যরের সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল। আমাদের একটাই ইচ্ছে, মারিয়াম যদি একবার আম্মির সঙ্গে এসে দেখা করে যান...”
মাকে একবারও অনুরোধ করেননি সিনেমাটা দেখার জন্য? “না, করিনি,” সাফ উত্তর দেন খালিদ। “আম্মি জানেন যে ১৮ অক্টোবর ‘শাহিদ’ মুক্তি পাচ্ছে। তবে ওঁকে সিনেমাটা দেখতে বলিনি। দেখলে জানি আবার ডুকরে ডুকরে কাঁদবেন। দুনিয়া শাহিদভাইয়ের ছবিটা দেখবে ঠিকই। তবে মায়ের মন! পরদায় দাদাকে আবার মারা যেতে দেখলে সেই ক্ষতের মলম পাব কোথায়?” |
|
|
|
|
|