কৃষ্ণনগরের এক সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিও। পুজোর দিন দশেক আগের এক রবিবারের দুপুর। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি। স্টুডিওর রেকর্ডিং রুমে ড্রাম, অর্গ্যান, লিড ও বেস গিটার নিয়ে তৈরি জনা ছয়েক তরুণ। নিঃশব্দ স্টুডিওর ঘরে ভেসে আসছে ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান, স্টার্ট। তারপর লাল আলো জ্বলে উঠতেই সতেজ গলায় ওই তরুণরা গেয়ে উঠলেন, ‘‘গভীর আঁধার আজ চারিদিকে। কালো ধোঁয়ায় ঢাকছে শহর। আকাশটাকেও ঘিরে ফেলছে সবাই। চারিদিকে সবুজ উধাও...।’
স্কোরিং রুমের বাইরে তখন খুশিতে ফেটে পড়ছে আরও জনা দশেক তরুণ। কলকাতার সুরুচি সংঘের মতো পুজো যা পারে, প্রত্যন্ত মফস্সলের পুজো উদ্যোক্তা হয়েও তাই করতে পারার আনন্দে তাঁদের আবেগ তখন বাঁধ ভাঙা। চিরাচরিত ধারার ব্যতিক্রম হয়েই নিজেদের থিম পুজোর জন্য থিম গান রেকর্ডিং করলেন নবদ্বীপ মণিপুর দুর্গা পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। তাঁদের দাবি, ২০১০ সালে নিজেদের থিম পুজোর জন্য প্রথম থিম গান ব্যবহার করেছিল কলকাতার সুরুচি সঙ্ঘ। পরের বছর সেই তালিকায় যোগ হয় নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ। সেই ধারাতেই অনুপ্রাণিত হয়ে মণিপুরের উদ্যোক্তাদের এই আয়োজন। গত দু’বছর ধরেই মণিপুরের থিম পুজো নবদ্বীপে দুর্গাপুজোর পরিমণ্ডলে তুমুল আলোড়ন তুলেছে। পুজোর ৬৪তম বর্ষে বিগত বছরগুলোর জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য পুজোর থিমের সঙ্গে এবারে তাই থিম গানকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন ওঁরা।
জনা আষ্টেক কলেজ পড়ুয়া এবং গানবাজনার সঙ্গে যুক্ত পুজো উদ্যোক্তাদের মিলিত প্রয়াস এই থিম গান। গানটি লিখেছেন শুভজ্যোতি। তাঁর কথায়, “থিমের পুজোর ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করেছি প্রতিমা, মণ্ডপ এবং আলোকসজ্জার মধ্যে দিয়ে থিমের যে ভাবনাটাকে আমরা ধরার চেষ্টা করি, উপযুক্ত আবহ সঙ্গীতের অভাবে তা যেন সম্পূর্ণ হত না। আমরা দেখেছি কলকাতার ওইসব মণ্ডপগুলো এই জায়গাতেই অন্যদের থেকে অনেকটা আলাদা। তাই আমরাও থিমকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে এবার থিম গান ব্যবহার করছি।”
সুদীপ্ত, অমিত, জিৎ, সাহেব, অঙ্কন, প্রদীপ্ত, রেমো এরাই মণিপুর পুজোর থিম টিম। সুদীপ্ত বলেন, “আমরা সারা বছর নিজেরা এক সঙ্গে গান বাজনা করি। তাই আমাদের পুজোয় থিম গান হবে না, এটা হতে পারে না। প্রস্তাবটা শোনার পর বড়রা যেভাবে প্রশ্রয় দিলেন তার পরে আর অন্য কোনও চিন্তা ভাবনার সুযোগ ছিল না।” এই পুজোর অন্যতম দুই উদ্যোক্তা শোভন শর্মা এবং মানস সাহা জানান, প্রতিমা দেখার জন্য মানুষ তিন ঘন্টা পর্যন্ত লাইন দিয়েছেন। তাঁদের মনে হয়েছে, এই অপেক্ষার সময়টিতে বিক্ষিপ্ত কোনও গান না বাজিয়ে যে থিম তাঁরা দেখতে চলেছেন সেই অনুযায়ী গান বা আবহ যদি তাঁদের শোনানো যায়, তাহলে দর্শক বিষয়বস্তুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন।
শুধু থিম গানই নয়, এ আর রহমান থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, হার্ড রক থেকে ভাটিয়ালি মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে থিম মিউজিকও। এবং সেই কাজও করছেন পেশাদার শিল্পীরা। আড়াই লক্ষ টাকা বাজেটের মণিপুরের পুজো এ বার তাই প্রতিমা থেকে মণ্ডপ, আলো থেকে আবহ সব কিছুতেই একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠবে, এমনটাই দাবি উদ্যোক্তাদের। |