|
|
|
|
বোধনে বিদায় বার্তা |
শেষটা কি শুরুর মতো, প্রশ্ন তুলবে ভাবীকাল |
গৌতম ভট্টাচার্য • লন্ডন |
বিশ্বের যেখানে যত বাঙালি আছেন, তাঁদের বিষণ্ণতার আঁধারে নিক্ষেপ করে সৌরভ বিদায় ঘোষণা করেছিলেন মহাষ্টমীর দিন।
বিশ্বের যেখানে যত ভারতীয় আছেন, তাঁদের হৃদয়কে অবশ করে দিয়ে সচিন তেন্ডুলকর অবসর ঘোষণা করলেন মহাষষ্ঠীর দুপুরে।
যথেষ্ট ভুল লেখা হল। আসলে বিশ্বের যেখানে যত ক্রিকেটপ্রেমী আছেন, তাঁদের একটা স্ট্রোকে নিশ্চুপ আর মুহ্যমান করে দিয়ে চলে যাচ্ছেন তেন্ডুলকর।
করাচিতে জাভেদ মিয়াঁদাদের এক বন্ধু বললেন, মিয়াঁদাদের মতো পোড়খাওয়া মানুষ নাকি খবরটা শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন। প্যারিস থেকে বৃহস্পতিবার শিল্ড বেরি ফোনে বললেন, “ফরাসি টিভিতে খবর দেখে এ দিন জানলাম।” ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার ইংল্যান্ডের ব্রাজিল বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্যায়ের ম্যাচ রয়েছে। তা নিয়ে ওয়েম্বলি সংলগ্ন এলাকা ইতিমধ্যেই উত্তেজনার বারুদে ঠাসা। বড় ফুটবল এ দেশে একটা অন্য মাত্রার ব্যাপার। ক্রিকেট কোথায় তার পাশে? কিন্তু স্টেডিয়ামের কাছাকাছি এলাকাগুলো, যেমন হ্যারো অন দ্য হিল, সাউথহল, এগুলো সব ভারতীয়তে ঠাসা। ভারতে থাকা ভারতীয়দের মতো তাঁরাও মুষড়ে পড়েছেন এই খবর শুনে। ইন্টারনেটের যুগে কোনও খবরই আর ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ থাকে না। তবু তেন্ডুলকরের খবর পেয়ে এখানে অনেকেই ভারতীয় নিউজ চ্যানেল চালিয়ে দেন। বারবার শুধু সচিনের খবরই দেখতে থাকেন। আসলে আবির্ভাবের চব্বিশ বছর বাদেও সচিন তেন্ডুলকর এমনই রোমান্সের বটগাছ যে, সমুদ্র-পাহাড়-জঙ্গল এগুলোকে সব ছাপিয়ে তাঁর একটা সিদ্ধান্তের প্রভাব ছড়িয়ে যায় গোটা পৃথিবীতে।
আচম্বিত এই সিদ্ধান্ত কিন্তু একটা প্রশ্ন রেখে দিল। যে রোমান্সে ক্রিকেটবিশ্ব এমন আচ্ছন্ন, তার শেষটা শুরুর মতো হল কি? উত্তর, হল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে, তা-ও যে হীনবল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচ খেলে ব্যাট তুলে রাখবেন তেন্ডুলকর, এটা কি কোথাও রূপকথার অন্তিম ফুটপাথ-যাত্রা হয়ে গেল না? সচিন বলেছেন, দু’শো টেস্ট খেলে খেলা ছেড়ে দেবেন। চার মিনিটের কমে এক মাইল ছোটা, এভারেস্টে ওঠা, পেলের হাজার গোল বা ফেডেরারের এতগুলো গ্র্যান্ড স্ল্যামের মতোই একটা অনন্য, অসাধারণ ব্যাপার দু’শো টেস্ট। কিন্তু মনে করা যাক, প্রথম টেস্টে চোট লাগল। তখন কী হবে? তখন কি দু’শো পূর্ণ না করেই ছেড়ে দেবেন? সিরিজে তো টেস্ট মাত্র দু’টো। |
|
“এগারো বছর বয়স থেকে শুধু ক্রিকেটই খেলে গিয়েছি, তাই
আমার পক্ষে ক্রিকেট ছাড়া জীবন কল্পনা করা খুব কঠিন।”
—সচিন |
|
লন্ডনে বসে প্রবাসী ভারতীয়দের দাউদাউ করা আবেগের বিস্ফোরণ দেখেও একটা জিনিস মাথায় পরিষ্কার হচ্ছে না, সিদ্ধান্ত কি সচিন নিজে নিলেন? না নিতে বাধ্য হলেন? এই দু’টোর যে কোনও একটা কারণ হতে পারে তাঁর সিদ্ধান্তের।
পয়লা নম্বর, বোর্ডের সচিন-নীতি তৈরিই ছিল যে, দু’শো অবধি ওকে খেলাও। তার পর সোজা বলে দাও, তোমার জায়গা গ্যারান্টি করতে পারছি না। শ্রীনিবাসন যত দিন পূর্ণাঙ্গ ভাবে ক্ষমতায় আসেননি, তত দিন হয়তো এই নীতি বাস্তবায়িত করতে সমস্যা হচ্ছিল। আদালত তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার পর হয়তো এই সিদ্ধান্তের কথা নির্বাচকরা সচিনকে জানিয়ে দিয়েছেন। যদি সত্যি হয়, তা হলে এক ঢিলে দুই পাখি মরল। বোর্ড সচিনের শেষ সিরিজ আয়োজন করে টিভি স্পনসরদের খুশি করে দিল। যারা এ বছর একটাও দেশের মাঠে টেস্ট ম্যাচ না পেয়ে তাদের উপর রেগে ছিল। দ্বিতীয়ত, হারুন লর্গ্যাটের দক্ষিণ আফ্রিকাকে তেন্ডুলকর নামক বাণিজ্যিক চুম্বক ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হল না। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রচুর হোটেলে রুম বুক হয়ে গিয়েছে সচিনকে শেষ বার দেখার জন্য। অনেক ট্র্যাভেল এজেন্সি ব্যবসা করে ফেলেছে। এ বার তাদের কী হবে?
সবচেয়ে বড় কথা সচিন নিজে বলেছিলেন যে, ডেল স্টেইনের ডেরায় তাঁকে খেলার জন্য তৈরি হচ্ছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য নয়। এমন আলোচনা যখন হচ্ছে, শোনা যায় সচিনের এজেন্ট সেখানে মিউমিউ করে বলেছিলেন, একটু বেশি ঝুঁকি হয়ে যাবে না? নাম খারাপের ভয় থাকবে না? সচিন তখন বলেছিলেন, নামটা খারাপ হলে আমার হবে। তোমার নয়। এটা মাত্র এক মাস আগেকার ঘটনা। মাঝখানের সময়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ছাড়া আর দৃশ্যত পরিবর্তনের কোনও কারণ নেই। নাকি নতুন মরসুমের শুরুতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলতে গিয়ে সচিন উপলব্ধি করলেন, আর টানতে পারছেন না? পাঁচ ম্যাচে করেছেন মাত্র ৭০। যে দিন সবচেয়ে ভাল ফর্মে ব্যাট করছিলেন কোটলায়, সে দিন করেছিলেন মাত্র ৩৫। যা তাঁর মাপে কোনও রানই নয়। তা হলে কি রিফ্লেক্স কাজ করছে না, সেটা বুঝলেন? নাকি পুরনো কোনও চোট মাথাচাড়া দিল? হঠাৎ কী এমন
ঘটল যে করাচিতে ওয়াকার-ওয়াসিম-ইমরানকে খেলা সবুজ পিচের রোমান্স থেকে ব্যাপারটা এমন রামপল- ব্রাভো-নারিন ছাড়া সহজ ছকের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ঘরের মাঠে খেলার পর্যায়ে নেমে এল? এ তো রোমান্সের ডিজাইনার বিয়োগান্ত পরিণতি!
কে জানত তেন্ডুলকর নিজের জন্য এটা শিরোধার্য করে রেখেছেন? |
শৃঙ্গের নাম সচিন |
• আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম একশো সেঞ্চুরি। টেস্টে ৫১, ওয়ান ডে-তে ৪৯।
• টেস্টে সব চেয়ে বেশি রান ১৫,৮৩৭
• ওয়ান ডে-তে সব চেয়ে বেশি রান ১৮,৪২৬
• ওয়ান ডে-তে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি ২০০ (বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১০)
• বিশ্বকাপে সব চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি (৬),
• হাফ সেঞ্চুরি (১৫) ও রান (২২৭৮) |
|
ভারতীয় কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মধ্যে এমন রোমান্সহীন চলে যাওয়া ঘটেছে কপিল দেব এবং গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের ক্ষেত্রে। রাহুল দ্রাবিড়— তিনি শেষ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার মাঠে। তার আগের দু’টো সিরিজ মিলিয়ে চারটে সেঞ্চুরি। রোমান্সের পারফিউম তাঁর আবির্ভাবে যে পরিমাণে ছিল, বিদায়বেলায় ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। গাওস্কর— তিনিও টেস্ট শেষ করেছেন পাকিস্তানের সঙ্গে চিন্নাস্বামীতে। শেষ পাঁচ দিনের ম্যাচ খেলেছেন লর্ডসে। আর শেষ ওয়ান ডে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর বাদ দিলে সচিনের বাকি বিদায়গুলো কোথায় সচিনোচিত হল? বিদায়ী দু’শো টেস্টে যদি সেঞ্চুরিও পান, অসম্ভব মাদকতা তৈরি হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ভাবীকাল আবেগতাড়িত না হয়ে জিজ্ঞেস করবে, আপনার শুরু যেমন চমকপ্রদ, শেষটা তেমন ছিল না কেন? তেন্ডুলকর বোর্ডের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলেছেন, সিদ্ধান্তটা তাঁর হৃদয় থেকে নেওয়া। কোথাও যেন মনে হচ্ছে, শুধু হৃদয় হলে তাঁর এক মাস আগের কথাটাই মিলে যেত। দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলে তিনি ডেল স্টেইনের গোলাগুলি খেলতে যেতেন।
তার বদলে এই চলে যাওয়া। যার বিষণ্ণতার মাত্রা শেষমেশ রিখটার স্কেলে কোথায় দাঁড়াবে কেউ জানে না। আসলে এমন ক্রিকেটারও তো কেউ কখনও দেখেনি যে চব্বিশ বছর যৌথ দায়িত্ব নিয়ে খেলছে। একটা ক্রিজে ব্যাট করেছেন নিজের জন্য। পাশাপাশি একটা সমান্তরাল ক্রিজে ব্যাট করেছেন সমর্থকদের জন্য। জীবনের আর পাঁচটা শাখার মতো ক্রিকেটেও ‘গ্রাহক’ যে গুরুত্বপূর্ণ, নিজের কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে তাকেও যে একটা জোগান দেওয়ার ব্যাপার থাকে, তা নিয়ে তেন্ডুলকরের মতো কেউ ধারাবাহিক দায়িত্বশীল থাকেননি।
নভেম্বরের শেষে মনে হচ্ছে মুম্বইয়ের বাঙালি সুরকারের গানটাই সত্যি হয়ে যাবে। ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর গান লেখার সময়ই নাকি নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমী শান্তনু মৈত্রর মনে হয়েছিল, এটা এখনকার মতো ফিল্মে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু আসলে তেন্ডুলকরের বিদায়ের জন্য তোলা থাকল। যখন লোকটা সত্যিই চলে যাবে, তখন বলা হবে—
বহতি হাওয়া সা থা উয়ো
উড়তি পতঙ্গ সা থা উয়ো
কাঁহা গয়া উসে ঢুন্ডো...।
এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে কোথায় গেল তার খোঁজ করো। নভেম্বর তো এসেই গেল!
|
|
“ক্রিকেট-ইতিহাসে এমন আর কোনও খেলোয়াড়ের কথা কল্পনা করা কঠিন, যে ধ্রুপদী টেকনিকের সঙ্গে নির্মম আগ্রাসনকে এ ভাবে মেশাতে পারে!”
সুনীল গাওস্কর |
“সচিনের জন্মগত প্রতিভা অবশ্যই ওর সাফল্যের বড় কারণ। কিন্তু ওই প্রতিভাকে ও যে ভাবে কাজে লাগিয়েছে, সেটা আরও বড় ব্যাপার।”
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় |
“ওহ্ না! আচমকা বুঝতে পারছি, নেশা কথাটার মানে কী! আমার ছিল লিটল মাস্টারের (খেলা দেখার) নেশা। এখন এই সচিন-হীন ক্রিকেট? অসহনীয়...!”
শাহরুখ খান |
|
পুরনো খবর: পরের আইপিএলে সচিন হয়তো টিমের ‘মাস্টার’ |
|
|
|
|
|