|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
পুজোর দিনে কাঁদে নাকি কেউ |
এই এক মুশকিল আপনার বয়সি বাঙালিদের নিয়ে, পুজো এলেই বড় পুরনো কথা মনে
পড়ে আপনাদের। কেবলই মনে হতে থাকে কী যেন একটা ছিল, হারিয়ে গিয়েছে!
শিলাদিত্য সেন |
ওগো আমার আগমনী আলো... ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শেষ হওয়ার পরও গানটার রেশ রয়ে গিয়েছিল ঘুমের মধ্যে। ভাঙা রেডিয়োটার কান মলে বকেয়া ঘুমটা সেরে নিচ্ছিলেন, ওমা— আপনার মোবাইলটা বাজছে! আচ্ছা, আপনি শোনেন বলে মহালয়ার দিন এত সকালে ফোন! গজরাতে গজরাতে ফোন ধরতেই আহ্লাদির গলা। বন্ধুর বোন, বেশ কিছু বছর পর দেশে ফিরেছে, বেঙ্গালুরু থাকে এখন। আপনি কিছু বলার আগেই তার গলায় উত্তেজনা: ‘জানো, কাল রাতে আমার মেয়ে ‘দাদার কীর্তি’ দেখে ভীষণ হাসছিল!’
ঘুমজড়ানো গলায় বলেই ফেললেন, ‘গুল মারারও একটা সীমা থাকে। কত বয়স তোমার মেয়ের যে, তরুণ মজুমদারের ছবি দেখে?’ এতটুকু দমে না আহ্লাদি: ‘বিশ্বাস করো। ফুলদি ডিভিডিটা পাঠিয়েছিল, চালিয়ে দেখতে গিয়ে হেসে কুটোপাটি আমার মেয়ে, সাত হয়নি এখনও।’ এ বার আপনার ঘুম চটে যাওয়ার পালা, ছ’বছরের বাচ্চা, তিরিশ বছর আগেকার ‘দাদার কীর্তি’ দেখে হাসছিল, কোন জায়গাটায়?
সেই যে সপ্তমীর সকাল, প্রবাসী বাঙালিদের পুজো, তিন দিন ধরে নাচ-গান-নাটক। ঢাকিরা ঢাক বাজাচ্ছে, গোল হয়ে বয়স্কদের গুলতানি, আর ভোম্বল, ছন্দবাণী ক্লাবের লিডার, ফেল-করা কেদারকে ছন্দ মিলিয়ে কথা বলা শেখাচ্ছে। মণ্ডপ থেকে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল যে ছেলেটি, তাকে হাঁক পাড়ে ভোম্বল: ‘অ্যাই, কে যায় হোথায়?’ ছেলেটি বলে: ‘সন্দীপ রায়।’ ভোম্বল: ‘অত তাড়াতাড়ি ছুটছিস কেন?’ ছেলেটি: ‘পুরুতমশাই আসেনি এখনও।’ ভোম্বল অবাক: ‘অ্যাঁ, সে কী!’ ছেলেটি চলে যেতে-যেতে বলে: ‘যাই দেখি।’
সেই সপ্তমীর সকালেই সিলেবাসের বাইরে থেকে কেদারের জীবনে হাজির হয় সরস্বতী, তার ধমক খেয়ে দুদ্দাড়িয়ে পালায় ছন্দবাণী-র ছেলের দল, হোঁচট খেতে খেতে পলায়নপর কেদারের চোখে চোখ পড়ে সরস্বতীর। সপ্তমীর সকালে চার চক্ষুর মিলনও বলতে পারেন। |
|
ছবি: অরিন্দম বিশ্বাস। |
মন খারাপ হয়ে গেল?... আচ্ছা তরুণবাবুর ছবিটা ক’বার দেখেছিলেন ক্লাস কেটে, বয়ঃসন্ধি তো তখন, আশির দশকের শুরু, বারো ক্লাসে পড়তেন, না কি ফার্স্ট ইয়ার? কেদার-সরস্বতীর মতো সে বার পুজোয় আপনিও কাউকে...
এই এক মুশকিল আপনার বয়সি বাঙালিদের নিয়ে, পুজো এলেই বড় পুরনো কথা মনে পড়ে আপনাদের। মনটা মেদুর হয়ে যায়, কত রকমের স্মৃতি এসে ভিড় করে। কেবলই মনে হতে থাকে কী যেন একটা ছিল, কী যেন একটা ছিল— হারিয়ে গিয়েছে! বড্ড মনকেমন করে।
মনকেমন করত বলেই না পুজোর কিছু দিন বাকি থাকতে মাঝে মাঝে ছোটমামির বাপের বাড়ির পাড়ায় চলে যেতেন। সত্তরের দশক তখন, স্কুলের ছুটির দিনগুলোয় নির্জন লর্ডস-এর মোড় থেকে লেক গার্ডেন্স-এর দিকে একটু ঢুকতেই ঘন ছায়ায় বুড়ো এক কুমোর কয়েক জন শাগরেদ নিয়ে মগ্ন প্রতিমা গড়ায়। ট্রাঙ্কে রং, চুল, রাংতা, গর্জন তেল, ছাগলের ঘাড়ের লোমের নানা মাপের তুলি, আরও কত কী। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকেন, কুমোররা চলে গেলেও নড়তে চান না। সম্পূর্ণ হতে-যাওয়া প্রতিমার মুখে যেন হাসি, শরতের আকাশ থেকে উৎসবের হাওয়া এসে লেগেছে তার সারা গায়ে।
পুজোর দিনগুলোয় আপনার বাবার গলায় একটু যেন বিষাদ লেগে থাকত। ও পার বাংলার মানুষ, বহু কাল দেশ-ছাড়া, কেমন নিরুদ্দিষ্টের স্বরে ছেলেবেলার গল্প শোনাতেন, শুনতে শুনতে এক ঝটকায় কে যেন আপনাকে তুলে ছুড়ে ফেলত অতীতে। বাবার দেশ-গাঁয়ের দুর্গাঠাকুর, ধুনুচি নাচ, ধুনোর গন্ধে ভরে গিয়েছে চার দিক। হঠাৎ খেয়াল হত আপনি কাঁদছেন। মা ছুটে এসে চোখ মুছিয়ে বলতেন ‘দুর বোকা, পুজোর দিনে কাঁদে নাকি কেউ! কত মজা এখন চার পাশে।’
ঠিকই, ধুম লেগে যেত কলকাতায়। পুজোর ক’দিন নৈবেদ্য, প্রসাদ, অঞ্জলি, নতুন জামাকাপড়, নতুন জুতো পরে পায়ে ফোস্কা, শক্ত মলাটে রঙিন পুজোবার্ষিকী, ঢোল, কাঁসি, আরতির ধোঁয়া, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে হেমন্ত সন্ধ্যা লতা মান্না সতীনাথ উৎপলা মানবেন্দ্র শ্যামল দ্বিজেন তরুণ আরতি আলপনা বনশ্রী নির্মলা মাধুরী সুবীর মৃণাল... রাত জেগে ঠাকুর দেখতে বেরনো, ফুচকা আলুকাবলি ঘুগনি বুড়ির-চুল হজমিগুলি, একটা ঘূর্ণির মতো দিনগুলো কেটে যেত।
কিন্তু কলকাতার পুজো আর ভাল লাগত না কলেজ জীবনে। বাবা-মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ছেলেবেলায় দেখা প্রবাসী বাঙালির পুজোই ঘুরে-ফিরে আসত মনের মধ্যে, আর পুজোয় সেই প্রবাসেই সবচেয়ে বেশি পালাতে চাইতেন আপনি। পঞ্চমী পর্যন্ত ঠিক হয়নি কোথায় যাবেন, অথচ পুজোর গন্ধে ম-ম চার পাশ। আপনার পায়ের-তলায়-সরষে। দুই দাদা এতটুকু চিন্তিত নয় তাতে। বলত: একটু গুছিয়ে-টুছিয়ে রাখ, সপ্তমীটা কাটতে দে, তার পর বেরিয়ে পড়লেই হবে। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, পালাই-পালাই মন। বেড়াতে গেলে গত শতকটায় এর বেশি কিছু লাগত না। সত্যজিতের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে কোথাও একটা গিয়ে হাজির হওয়া। দিনক্ষণ বাছা বা বাক্স-প্যাঁটরা গুছোনোর বালাই ছিল না। এক দিন বা এক ঘণ্টার নোটিসে কেটে পড়লেই হল। ওড়িশা-মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে বেলপাহাড়। দূরে ছোট পাহাড়ের সারি। রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধূসর হয়ে মিলিয়ে যায় আকাশের তলায়। জঙ্গলের বেষ্টনে ঝিঁঝিঁ-র পাখার মতো অল্প-অল্প কাঁপতে থাকে রোদ। মুরগুমার বাংলোয় ধু-ধু জ্যোৎস্না। চুঁইয়ে চুঁইয়ে চাঁদের ঠান্ডা আলো ভিজিয়ে দিত আপনাকে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত। হাওড়া থেকে ধলভূমগড় হয়ে ভালপাহাড়। পৌঁছেই আপনার কান দুটো, কলকাতায় যেগুলো বন্ধ হয়ে থাকে, অশ্রুত খুঁটিনাটি শব্দ শোনার খেলা পেয়ে যেত একটা, এত নির্জন চার পাশ। হরেক রকম শব্দ, শিশির কিংবা ফুলের, নগ্ন পাতা কিংবা আদুড় ঘাসের। ভোররাতে ট্রেন থেকে নেমেছিলেন জশিডি, সেখান থেকে মাইল পাঁচেকের পথ— রিখিয়া। একটা টাঙায় আপনি আপনার দুই দাদা-সহ বন্ধুরা ছ’জনই এঁটে গেলেন, মালপত্র ছিল সামান্য। সারাটা পথ শিউলি ফুলের গন্ধ। রিখিয়ায় যে বাড়িতে থাকতেন, তার কেয়ারটেকার বদরিদা দারুণ রাঁধত বলে খিদে বেড়ে গেল আপনাদের। গায়ে রোদ মেখে কুয়োর ঠান্ডা জলে স্নান। সামনে খোলা মাঠ। মাঠ পেরিয়ে পাহাড়। আশ্বিনেও আচমকা বৃষ্টি নামত পাহাড়ের ও পাশে, চোখে সে-ছবি পলক ফেলতে না ফেলতেই ছুঁয়ে যেত আপনার শরীর। লক্ষ্মীপুজো অব্দি গাছের পাতায় শিশিরের শব্দ, ভোরের হিম-হিম কুয়াশায় হারিয়ে যেত পথ। প্রতিদিন একটু একটু করে পূর্ণ চাঁদের দিকে এগোনো রাতগুলোয় যেন পরি নামত জ্যোৎস্না-ধোয়া প্রান্তরে। পুরনো পরিত্যক্ত সব বাড়ি, দেখে গা ছমছম করত, জমে উঠত ভূতের গল্প। দিনের ঠা-ঠা রোদে রিখিয়া ঝলমলে রঙিন, দেহাতি মেয়েদের রংবেরঙের শাড়ি, হাট বসত বিকেলে ঝুরি-নামানো বটের তলায়। আকাশ ছেয়ে যেত গোধূলির লাল মেঘে। চেয়ে থাকতে থাকতে কুশল বিষণ্ণ গলায় বলত, ‘পুজোর সময় আশ্বিনের রোদটা দেখলে বড্ড মনকেমন করে, হারানো প্রিয় মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।’ কুশল নেই। সপ্তমীর সকালে যার সঙ্গে তুমুল আড্ডা হত, সেই রুনুদা নেই। গড়িয়াহাট, ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের উল্টো দিকের রাস্তায় একটা বাড়িতে বিসর্জনের পর গেলে যে সুলেখা কাকিমা আপনাকে ‘এলোঝেলো’ (রবীন্দ্রনাথ মিষ্টিটার নাম রেখেছিলেন ‘পরিবন্ধ’) খাওয়াতেন, সেই সুলেখা কাকিমাও নেই। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায় এমন চমৎকার নারকেলের মিষ্টি বানিয়ে নিউ ব্যারাকপুর থেকে বিজয়া করতে আসতেন যে বড়পিসিমা, তিনিও নেই। মা-বাবা তো নেই-ই, একটা দিদি ছিল, সে-ও নেই।
সপ্তমীর শেষ রাতে ঘুম ভেঙে এই নেই-হওয়া মুখগুলো মনে পড়বেই। বারান্দায় এসে দেখবেন শুক্লপক্ষের কাঁচা জ্যোৎস্নায় চারিদিক শুনশান। ওই আবছা আলোয় সেই মেয়েটিকে মনে পড়বে, যে আপনাকে মণীন্দ্র গুপ্তের ‘অক্ষয় মালবেরী’ পড়িয়েছিল, ‘অক্ষয় মালবেরী গাছকে ঘিরে তীব্র ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ টের পাই, কখন সঙ্গীদের হাত ফসকে গেছে। প্রৌঢ় মুখের ওপর ছায়া পড়ে। নিজেকে আর মানুষ বলে মনে হয় না... ভিতরে একা, সুখী না, দুঃখীও না। দশদিকে অসীম শূন্য এবং চিররহস্য!’ |
|
|
|
|
|