কলিকাতা আর সেই কলিকাতাতে নাই। নড়িতে চড়িতে দিনে দিনে মহানগরী হইয়া উঠিয়াছে। উত্তর-মধ্য-দক্ষিণ ছাড়াইয়া এ ক্ষণে পূর্বে বাইপাসে জাগিয়া উঠিয়াছে ভিন্ন রুচির ভিন্ন অস্তিত্বের নগরী। খালের ধার ধরিয়া বাইপাস-সংলগ্ন এলাকায় যে বসতিগুলি ছিল, তাহার অনেকই ভোজবাজির মতো মিলাইয়া গিয়াছে। অর্থের প্রতিপত্তি, বাণিজ্যের শক্তি, বিশ্বায়নের মর্জি। রাতে মশা দিনে মাছি নয়, বরং বলিতে শখ হইতে পারে, শপিং মলে বিশ্বায়নে দিব্য বাঁচিয়াছি। যাহা হউক, ঈশ্বর গুপ্ত যখন এই মশা-মাছির ছড়া রচনা করিয়াছিলেন, তখন তো পুরাতন কলিকাতা কতগুলি পাড়ার সমষ্টিমাত্র ছিল। সাহেব পাড়া আর নেটিভ পাড়া, ইহাই বৃহৎ বিভাজন— ইংরেজি ভাষায় হোয়াইট টাউন ও ব্ল্যাক টাউন। নেটিভ পাড়ায় আবার বৃত্তি অনুযায়ী বিবিধ মহল্লা। নানা মহল্লার নানা উৎসব। নানা পল্লিতে নানা আয়োজন। কাঁসারি পাড়ায় সং বাহির হইত, জেলে পাড়ায় যাত্রার আসর বসিত, পল্লিতে পল্লিতে বারোইয়ারির পূজা জমিত, বাবুদের বাড়িতে পুজোর হুজ্জুতে বাইজি আসিতেন— এ পাড়ার বাবু ও পাড়ার বাবুকে টেক্কা মারিতেন। কী ভাবে টেক্কা মারিলেন তাহা লইয়া বৎসর ব্যাপিয়া রসাল গুলতানি চলিত। ইহার পারিষদবর্গ উহার পারিষদবর্গকে মুখে তোয়াইয়া দিতেন। পাড়ায় পাড়ায় এই প্রতিযোগিতার পরম্পরা বিশ শতকেও বজায় ছিল। পাড়া বিশেষে কলিকাতাবাসীদের চরিত্রের প্রকার নির্ণীত হইত। শরৎচন্দ্রের নতুনদা স্মরণীয়। দর্জিপাড়ার দাদা মানেই সাংঘাতিক দাদা।
শারদোৎসবের মাসখানেক আগে হইতে ইদানীং আবার যেন পুরাতন পাড়া কালচারের অভ্যুদয় হয়। অমুক বাগানের পূজা, তমুক পল্লির পূজা। কোন পল্লির কোন বাগানের পূজার এ বার থিম কী, তাহা লইয়া সগৌরব বিজ্ঞাপন। ইহাদের থিম উহাদের থিমকে পরাভূত করিয়া বিচারকদের নিকট জয়ীর মর্যাদা লাভ করিলে যেন পাড়া-জাতীয়তার জয়। এই পূজা কর্মকর্তারা পাড়াকেই তুলিয়া ধরিতে বদ্ধপরিকর। তবে ইহা পুরাতন অর্থে পাড়ার প্রত্যাবর্তন নহে। পুরাতন পাড়ার সংস্কৃতিতে পুঁজি ও স্পনসরের এইরূপ প্রতিপত্তি ছিল না। পাড়ার মানুষজনের অংশগ্রহণই ছিল সেই পল্লি-সংস্কৃতির চালিকা শক্তি। সেই ভিতর হইতে জাগিয়া উঠিবার ঘটনাটি আর ঘটে না, পুঁজির প্রতাপে থিম পূজার সময় কলিকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে এক্ষণে ‘ইভেন্ট’ জমিয়া উঠে। কেনাকাটা চলে, ইহাতে অর্থনীতির পুষ্টি। এই পুষ্টির জন্য পাড়া বা পল্লির সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করা হইতেছে মাত্র। ‘যিনি’ যেখানে থাকেন ‘তিনি’ যে সেই পূজায় অংশগ্রহণ করিতেছেন, তাহা নাও হইতে পারে। পল্লির প্রবীণ বাসিন্দাদের চাহিতে পূজার উদ্বোধনে সেলেব্রিটিদের চাহিদা বেশি। কারণ সেলেব্রিটিদের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ আছে, পাড়ার বহু কালের বাসিন্দাদের তাহা নাই। ইহা অনিবার্য। দাও ফিরিয়া সেই পাড়া, লহ এ মহানগরী— বলিবার কারণ নাই। বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছিলেন ঈশ্বর গুপ্তের ন্যায় খাঁটি বাঙালি কবি আর হয় না, ঈশ্বর গুপ্তের ন্যায় খাঁটি বাঙালি কবি আর চাহি না। সেই সুরেই বলিতে হয়, কলিকাতার পুরাতন খাঁটি পাড়ার প্রত্যাবর্তন আর হয় না, এই প্রত্যাবর্তন আর চাহি না। পাড়ার মধ্যে কোন্দল, কলহ, অলজ্জতা, স্থানিক ঈর্ষা ছিল। সেই অশিষ্টতা ও কূপমণ্ডূকতা কাম্য নহে। কেবল, পাড়ার মধ্যে অংশগ্রহণ ও মানুষে-মানুষে টানের সংস্কৃতিও ছিল। তাহা কি ফিরিতে পারে না! |