লালুজি বা লালুপ্রসাদ হতে যতটা সময় লেগেছিল, তার ক্ষণ-ভগ্নাংশে তিনি পুনরায় লালু-লালুয়া-লাল্লু। ১৯৯০-এ যখন মুখ্যমন্ত্রী হন, ভারতীয় বর্ণ-ভদ্ররা তাঁকে ‘লালু’র ওপরে কিছু ভাবতে পারেনি; অল্প দিনে ভূরাবালদের (ভূমিহার-রাজপুত-ব্রাহ্মণ-লালা) অক্ষম ক্রোধে তিনি ‘লালুয়া’; ১৯৯৫-এ বিশেষজ্ঞ-পূর্বানুমান নস্যাৎ করে পুনরায় ক্ষমতায় আসার প্রাক্কালেও জাতীয় সংবাদমাধ্যমের তিরন্দাজদের কাছে তিনি ‘লাল্লু’। কেবল জাতপাত সমীকরণ নয়, সমাজের জটিল অভ্যন্তরে প্রবল নড়াচড়ার লক্ষণের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি যখন সবে ‘লালুপ্রসাদ’ হয়ে উঠছেন, তখনই চারা ঘোটালা, ফের লালুয়া। ঐতিহাসিক ভাবে গড়ে ওঠা প্রশাসন-অনভিজ্ঞতার কারণে রাজনীতি-সফল লালুপ্রসাদ হয়ে দাঁড়ালেন ব্যর্থ এক প্রশাসক, যার দণ্ড তাঁকে সতেরো বছর ধরে ভোগ করে আসতে হয়েছে, এবং আরও বাকি।
কিন্তু, বহু বহু ‘লালুয়া’র পক্ষ থেকে লালুপ্রসাদ হয়ে ওঠার সামাজিক-রাজনৈতিক কর্তব্যটা যে ভারতীয় ইতিহাসের অনেক নিপীড়ন ও অপমানের মধ্যে নিহিত। সেটা শুধু পিছড়ে বর্গের নেতা হিসেবে বা করাল হিন্দুত্বের প্রতীকী রথযাত্রা আটকানোর হিম্মত দেখিয়ে অর্জিত হওয়ার নয়; প্রশাসক হিসেবে নিজের দূরদর্শী দক্ষতা প্রমাণ করেই তিনি সেটা অর্জন করলেন পাঁচ বছর রেলমন্ত্রী হিসেবে কাজ করে— লালু থেকে লালুপ্রসাদ।
কিন্তু সি বি আই বিশেষ আদালতের রায়টি ঘোষণামাত্র মাইক্রোফোন, কলম, কম্পিউটার কি-বোর্ডে সোল্লাস চিৎকার: ‘ধর্মের কল, নড়েছে নড়েছে বাতাসে’। কোন ধর্ম, কোন কল, কোন বাতাসে তা নড়ে, তা রাষ্ট্র ও সমাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। কিন্তু একটা সোজা প্রশ্ন করা যেতেই পারে। বাস্তবিকই কি লালুপ্রসাদের যাবৎ উত্তরণ-কথা বিস্মৃতির গর্ভে নিমজ্জিত করা যায়?
তদন্তে তিনি অপরাধী, আইনে তাঁর সাজা হয়েছে। যদিও এ বিচার চূড়ান্ত নয়, তাঁর জন্য উচ্চতর আদালতে বিচার-প্রার্থনার সুযোগ আছে, এবং নিম্ন আদালতে নির্দোষ বা দোষী অনেক সময়ই উচ্চ আদালতে দোষী বা নির্দোষ ঘোষিত হন। সে যা-ই হোক, আইনের বিধান যেমন পঠিত হবে, লালুপ্রসাদের ভবিষ্যৎ তেমন ভাবে নির্ধারিত হবে। কিন্তু কেবল একটা রায়, একটা ঘটনা দিয়ে লালুপ্রসাদের মতো ভারতীয় রাজনীতির এক বৈশিষ্ট্যকে ‘লালুয়া’তে পরিণত করাটা কি কেবল আইনের প্রতি আনুগত্যেরই প্রকাশ? না কি অন্য কিছু? এটা ভাবতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে দু’দশক আগের বিহারে, যেখানে রাজপুত-ভূমিহারের বাড়ির সামনে দিয়ে চপ্পল পায়ে, ছাতা মাথায় জীবনে প্রথম বার হেঁটে যেতে শুরু করেছে ডোম, চামার, পাসি; ‘জিন্গি মেঁ পহলি বার’ নিজের ভোট নিজে দিতে শুরু করেছে তারা। প্রথম বার সামন্ততন্ত্রের মেরুদণ্ডে আঘাত হানছে জাতপাত-দীর্ণ সমাজ, জাতি অবদমনের নামে মানব অবদমন ভাঙার লালুপ্রসাদী অনড় প্রতিজ্ঞায়। হিন্দুত্বের হিংস্র নখরাঘাতে রক্তে ভেসে গিয়েছে ভাগলপুরের মুসলমান, প্রত্যেক রামনবমী ও সরস্বতী পূজার আগমনে আতঙ্কে দিন গোনা শুরু হত তাদের। আর সেই সময়েই লালুপ্রসাদের প্রখর সাহসী উচ্চারণ: ‘সরকার ন চাহিঁ তো দঙ্গাঁ ন হোই— সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না।’ তাঁর সরকারের দাঙ্গা না চাওয়ার দূরপ্রসারী ফলে বিহারে দাঙ্গার রাজনীতি অপসৃত হয়েছে। সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষা তাঁর রাজনীতির অঙ্গ নিশ্চয়ই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি তাঁর বিশ্বাসের অঙ্গ। সে বিশ্বাসে আপস করলে তিনি যে নিজের ‘নিরপরাধ’ প্রমাণ কিনে নিতে পারতেন, ঘরোয়া আলোচনায় এটা তাঁর অনেক সমালোচক মানেন। এই লালুপ্রসাদকে ‘লালুয়া’ বানানোর একটাই মানে: ভারতীয় সমাজের জটিলতা থেকে উদ্ভূত নানা অবৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো এক রাজনীতির সামনে থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা। তাকে অস্বীকার করা। কিন্তু ‘লালুয়া’কে অবজ্ঞা করা যত সহজ, তাঁর রাজনীতিকে সুভদ্র আইনি বাক্যজালে আটকে রাখা তার চেয়ে অনেক কঠিন, সে রাজনীতির যত দোষত্রুটিই থাক না কেন। |