ছ’ঘণ্টার সড়ক-যাত্রা। পৌঁছে কর্তাদের কাছে তদ্বির, বিধায়কের সুপারিশ দাখিল ইত্যাদির পালা।
এ ভাবে টানা আট ঘণ্টার চেষ্টায় ফল মিলেছিল। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে একটা বেড জুটেছিল সেলিনা বিবির (নাম পরিবর্তিত)। তা-ও পুরো শয্যা নয়। তৃতীয় অংশীদার হিসেবে।
তাতে কী? ওয়ার্ডের বেশির ভাগ শয্যাতেই তো দু’জন-তিন জন। তার পরেও মেঝে উপচে পড়েছে। এক পা এগোতে গেলে রোগিণীর গায়ে পা ঠেকে যায়। টয়লেটের জল রোগিণীর গায়ে এসে লাগছে। প্রতি পদে সংক্রমণের ভয়। এই পরিস্থিতিতে একটা বেডে ঠাঁই পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলেন সেলিনা। পরিজনেরা স্বস্তির শ্বাস ছেড়েছিলেন।
সেই রাতেই সেলিনার পেটে ব্যথা শুরু হয়। প্রসব বেদনা মনে করে ডাক্তারেরা পাঠিয়ে দেন লেবর রুমে। সেখানে বারো ঘণ্টা রেখে বোঝা যায়, প্রসবের দেরি আছে। অগত্যা ওয়ার্ডে ফেরত। ফিরে সেলিনা দেখলেন, শয্যা দখল হয়ে গিয়েছে! তাঁর ছেড়ে যাওয়া জায়গাটি মাঝের বারো ঘণ্টায় গিয়ে জুটেছে আর এক প্রসূতির বরাতে!
এমতাবস্থায় সেলিনাকে আপাতত বাড়ি চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। পূর্ব মেদিনীপুরে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন ওই বধূ। কিন্তু প্রসবের জন্য সেই পূর্ব মেদিনীপুর থেকে উজিয়ে তাঁকে কলকাতায় আসতে হল কেন? বাড়ির লোকের অভিযোগ, সদর হাসপাতাল তো বটেই, জেলার মেডিক্যাল কলেজেও তাঁরা গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের বলা হয়েছে, বাচ্চার ওজন কম, প্রসবে ঝুঁকি রয়েছে। তাই কলকাতায় যাওয়াই ভাল। ডাক্তারবাবুর কথা ওঁরা ফেলবেন কোন ভরসায়?
অতএব প্রসূতিকে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি। পরিণতিতে শুধুই ভোগান্তি। প্রসূতির বিপদের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে মানে মানে বাড়ি ফেরা। সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গে ‘রেফারেল সিস্টেম’-এর হাল ঠিক কেমন, সেলিনার দুর্ভোগ-চিত্রে তা স্পষ্ট। জেলার হাসপাতালে বেড খালি পড়ে থাকে। কলকাতা উপচে পড়ে রোগীর ভিড়ে। ৭০ জনের ওয়ার্ডে জায়গা করে নেন দ্বিগুণের বেশি রোগী। পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করতে করতে ক্রমশ নষ্ট হয় চিকিৎসার মান। বিপন্ন হয় স্বাস্থ্য। নিত্য যেমন হচ্ছে এসএসকেএমে।
‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ এসএসকেএম হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের লাগোয়া বারান্দায় রোগী ভর্তি হচ্ছে। অথচ বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি, যে কোনও ধরনের রেডিয়েশন ইউনিটের আশপাশে থাকলে রশ্মির প্রভাবে শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। এ ব্যাপারে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনেরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা হলে?
এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের ব্যাখ্যা, “কিচ্ছু করার নেই। আদালতের নির্দেশ রয়েছে। এক জন রোগীকেও ফেরাতে পারব না। সবাইকে জায়গা দিতে গিয়ে এই অবস্থা।” বস্তুত এই বাধ্যবাধকতা মানতে গিয়ে হাসপাতালের খাস প্রশাসনিক ভবনেও রোগী ভর্তি করার মতো পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন অধিকর্তা। এবং এ জন্য তিনি দায়ী করছেন যথেচ্ছ রেফারের রেওয়াজকে। “জটিলতা না-থাকলেও জেলার রোগীদের সোজা কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকী, কলকাতার অন্যান্য হাসপাতালও এসএসকেএমে রেফার করে দায় এড়াচ্ছে।” আক্ষেপ প্রদীপবাবুর।
এই প্রবণতা যে শুধু কলকাতার সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড নুইয়ে দিচ্ছে, তা-ই নয়। অহেতুক রেফারের জেরে রোগীমৃত্যুর নজিরও ভুরি ভুরি। তাপস প্রামাণিকের কথা ধরা যাক। মাথায় গুরুতর চোট নিয়ে বর্ধমান মেডিক্যালে গিয়েছিলেন ওই প্রৌঢ়। দ্রুত অস্ত্রোপচার দরকার ছিল। বর্ধমান তাঁকে রেফার করে দেয় কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যালে। সেখান থেকে এনআরএস, শেষে এসএসকেএম। একটা শয্যা যখন জুটল, তার পনেরো মিনিটের মধ্যে সব শেষ। চিকিৎসকেরা স্বীকার করেছিলেন, এমন ক্ষত নিয়ে টানা ঘোরাঘুরি ও অবিরাম রক্তক্ষরণই তাঁর মৃত্যুর কারণ। ঘটনা হল, ন্যাশনাল, এনআরএস দু’জায়গাতেই মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা রয়েছে। তবু কেন তারা দায়িত্ব নিল না, সে প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মেলেনি। কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের এক তরুণ চিকিৎসকের স্বীকারোক্তি, “কোন সময় রেফার করা দরকার, তা নির্ণয় করতে হামেশাই অসুবিধা হয়। আগে হলে সমস্যা, পরে হলে তো পিঠ বাঁচানো মুশকিল। প্রায়শ ঝামেলা এড়াতে তড়িঘড়ি অন্য জায়গায় রেফার করে দেওয়া হয়।”
খাস কলকাতায় যখন এই অবস্থা, তখন জেলার হাল সহজেই অনুমেয়। জেলা থেকে কলকাতা, কিংবা কলকাতার এক হাসপাতাল থেকে অন্যত্র অকারণ রেফারের হিড়িক ঠেকাতে বছর দেড়েক আগে ‘রেফারেল রেজিস্টার’ তৈরি হয়েছিল। নিয়ম হয়েছিল, কাউকে রেফার করতে হলে বিস্তারিত ভাবে কারণ জানাতে হবে। অভিযোগ, গোড়ায় দিন কয়েক তা মানা হলেও পরে যে-কে-সে-ই। রেজিস্টারে পুরু ধুলো জমেছে। স্বাস্থ্য-কর্তারা কালেভদ্রে পরিদর্শনে গেলে ধুলো মোছা হয়। “আসলে নিয়ম মানার মতো কোনও পরিকাঠামোই তৈরি হয়নি। রেফারেল রেজিস্টার কে দেখবেন, বিধিভঙ্গের শাস্তি কী, কিছুই পরিষ্কার করে বলা হয়নি। তাই নিয়ম রয়ে গিয়েছে কাগজে-কলমে।” বলেন জেলা হাসপাতালের এক চিকিৎসক।
স্বাস্থ্য-কর্তারাও মানছেন, দায়বদ্ধতা তৈরি করা না-গেলে এই পরিস্থিতি বদলাবে না। সে জন্য সরকার কী করছে?
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের আশ্বাস, “দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। আমরা দফায় দফায় আলোচনা করছি। রেফারেল সিস্টেমকে চাঙ্গা করতে সব রকম চেষ্টা চলছে। কোনও রকম ত্রুটি বরদাস্ত করা হবে না।” স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান সুব্রত মৈত্র বলেন, “বহু ক্ষেত্রে জেলায় আইটিইউ না-থাকায় রোগীকে কলকাতায় পাঠাতে হয়। এটা মাথায় রেখে জেলায় জেলায় মোট চল্লিশটি আইটিইউ খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে ছ’টি চালু হয়ে গিয়েছে। সব মানুষ যাতে বাড়ির পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ পরিষেবা পান, তা নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য।”
উদ্যোগের সুফল মিলতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সুব্রতবাবু। যদিও রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতা বলছে, অতীতে এমন বহু পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত মাঠে মারা গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কী হয়, আপাতত তারই প্রতীক্ষা।
|