শরীরের সব রক্ত মাথায় জমা হওয়া অসুখের লক্ষণ। সরকারি স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাতেও সেই সঙ্কট।
কলকাতামুখী রোগীস্রোতে পরিষেবায় ত্রাহি রব। সমস্যার শিকড়সন্ধানে আনন্দবাজার। |
নিরাময়ের আশায় রোগীকে নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতায় ছুটে আসার দরকার নেই। জেলাতেই মিলবে সুচিকিৎসার যাবতীয় বন্দোবস্ত। মানুষের দুর্ভোগের যেমন সুরাহা হবে, তেমন চাপ কমবে মহানগরের হাসপাতালে। সব মিলিয়ে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
এই লক্ষ্য নিয়ে সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কলকাতার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সমস্ত জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল বাম আমলে। নতুন সরকারের স্বাস্থ্য-নীতিতেও ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ সমান গুরুত্ব পেয়েছে। যার প্রধান অঙ্গ হিসেবে জোর দেওয়া হয়েছে ‘রেফারেল সিস্টেম’-এর আমূল সংস্কারে। বিশেষত প্রসূতি ও শিশুর মৃত্যু-হার কমাতে জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছে ‘সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ)। কিন্তু তাতে যে তেমন লাভ হয়নি, তা দেখিয়ে দিল কলকাতার বিসি রায় শিশু হাসপাতালে ফের পরের পর শিশুমৃত্যুর ঘটনা।
এর প্রেক্ষাপটে আঙুল উঠছে সেই রেফারেল সিস্টেমের গলদের দিকেই।
মাসখানেক আগে বিসি রায়ে মাত্র সাত দিনে ৫২টি শিশু মারা গিয়েছিল। তার পরেও বিভিন্ন সময়ে অল্প ব্যবধানে বেশ কিছু মত্যুর খবর মিলেছে। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের দাবি, শিশুগুলি এসেইছিল অত্যন্ত মুমূর্ষু অবস্থায়, তাঁদের কিছু করার ছিল না। ঘটনা হল, ওদের অধিকাংশ এসেছিল অন্যান্য জেলা থেকে, যেখানে এসএনসিইউ রয়েছে (যেমন হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর বা বাঁকুড়া)। তবু তাদের কলকাতায় ‘রেফার’ করা হল কেন, স্বাস্থ্য ভবন আপাতত তার উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত। দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের শো-কজের পালাও চলেছে। অথচ সমস্যার শিকড়ে গিয়ে সেটি নির্মূল করার উদ্যোগ সে ভাবে চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ। মূল সমস্যাটা কী?
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রাক্তন স্বাস্থ্য-কর্তাদের ব্যাখ্যা: সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবায় তিনটি স্তর প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টার্শিয়ারি। গুরুত্ব বুঝে রোগীকে এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে পাঠাতে (রেফার করতে) হয়। এই ‘গুরুত্ব বোঝা’র ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আপেক্ষিক। ফলে অযথা বিস্তর রোগীকে উচ্চতর স্তরে রেফার করে দেওয়া হচ্ছে। তাই মামুলি জ্বর-পেট খারাপ কিংবা সাধারণ অস্ত্রোপচারের রোগীও হামেশা গ্রাম-মফস্সল থেকে কলকাতায় পাড়ি দিচ্ছেন। এতে জেলাস্তরে মজুত পরিকাঠামো কাজে লাগছে না। অন্য দিকে রোগীর বিপদও বাড়ছে বই কমছে না!
দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসছে বিসি রায়ে শিশুমৃত্যু। কলকাতার সরকারি-বেসরকারি শিশু-চিকিৎসকদের বড় অংশের দাবি: মুমূর্ষু বাচ্চাগুলিকে কলকাতায় আনাটাই কাল হয়েছে। শিশু-চিকিৎসক সুব্রত চক্রবর্তীর কথায়, “রুগ্ণ সদ্যোজাতের শরীর অত যাতায়াতের ধকল সইতে পারে না। হিতে বিপরীত হয়। কাছাকাছি হাসপাতাল বা এসএনসিইউয়ে চিকিৎসা হলে হয়তো সকলের এমন পরিণতি ঘটত না।” নির্বিচার রেফারের জন্য কি শুধু ‘গুরুত্ব অনুধাবনের’ অক্ষমতাই দায়ী?
স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশ তা মানতে নারাজ। ওঁদের মতে, কোথাও কোথাও দায় এড়ানোর প্রবণতাও কাজ করছে। যার পিছনে ‘সরকারি রক্তচক্ষু’র ভূমিকা দেখছেন অনেকে। এই মহলের বক্তব্য: মা-শিশুর মৃত্যু-হার কমাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড়া টাস্ক ফোর্স হুঁশিয়ারি দিয়েছে, কোনও হাসপাতালে এক সপ্তাহে তিনটির বেশি শিশুর মৃত্যু হলে তদন্ত হবে। “এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি। তদন্তের জুজু এড়াতে গুরুতর রোগীকে পত্রপাঠ কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে।” মন্তব্য এক স্বাস্থ্য-কর্তার।
পাশাপাশি পরিকাঠামোর দুর্দশা তো আছেই। জেলার হাসপাতাল-কর্তাদের আক্ষেপ, তাঁদের ভাঁড়ারে হাঁড়ির হাল। মেদিনীপুর মেডিক্যালের এসএনসিইউ-এর এক চিকিৎসক বলছেন, “ডাক্তার বাড়ন্ত, নার্সও কম। রোজ তিন শিফ্টে কাজ করারই লোক নেই! শুধু কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে কি চিকিৎসা হয়?” বর্ধমান মেডিক্যালের এক শিশু-চিকিৎসকের প্রশ্ন, “এসএনসিইউয়ে ডাক্তার-নার্সের আলাদা ট্রেনিং লাগে। অধিকাংশের নেই। ঝুঁকি নেব কী ভাবে? বাচ্চা মারা গেলে জনরোষ ঠেকাবে কে?”
জেলায় না হয় এত প্রতিকূলতা। খাস কলকাতার ছবিটা কেমন?
আদৌ আশাপ্রদ নয়। এসএনসিইউয়ের সংখ্যা-দৌড়ে টক্কর দিতে গিয়ে প্রায় সর্বত্র বিপত্তি। যেমন বিসি রায়ের ক্রিটিক্যাল কেয়ারে গত এক বছরে শয্যা প্রায় পঞ্চাশটি বাড়লেও ডাক্তারের সংখ্যা বাড়েনি। সামাল দিতে অন্যান্য এসএনসিইউয়ের ডাক্তারদের তুলে আনা হচ্ছে। যেখান থেকে আনা হচ্ছে, সেখানে তালা ঝোলার দশা। মাস কয়েক আগে চালু হওয়া কলকাতা মেডিক্যালের এসএনসিইউ-ও তথৈবচ। তার একশো বেডের পঁয়ত্রিশটি ইতিমধ্যে অন্য নানা বিভাগের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। বাকি ৬৫টি সুষ্ঠু ভাবে চালানোর মতো পরিকাঠামো নেই, অগত্যা বহু রোগীকে বিসি রায়ে পাঠানো হচ্ছে। আরজিকর, ন্যাশনালেও এসএনসিইউ ধুঁকছে ডাক্তারের অভাবে।
স্বাস্থ্য-প্রশাসন কী বলে? মুখ্যমন্ত্রীর গড়া টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি: একেবারে ‘নেই’ থেকে শুরু হওয়ায় ‘আছে’তে পৌঁছতে সময় লাগবে। তিনি বলেন, “অকারণ রেফারের ঘটনা কমলেও বন্ধ করা যায়নি। রোজ আলোচনা করছি, জেলায় নির্দেশ পাঠাচ্ছি। দেখা যাক, কতটা কী করা যায়।” তবে এ জন্য শুধু ডাক্তার বা পরিকাঠামোকে দোষ দিচ্ছেন না ত্রিদিববাবু। “সামান্য কিছু হলেও কলকাতায় চলে আসাটা মানুষের মজ্জাগত।” মন্তব্য তাঁর।
কিন্তু এমন প্রবণতা তৈরির জন্য জেলার প্রতি নিরন্তর অবহেলাও কি দায়ী নয়? স্বাস্থ্য-প্রশাসনের তরফে সদুত্তর মেলেনি। এ দিকে জেলার বাড়তি ভারে নাভিশ্বাস উঠছে মহানগরের। ভুক্তভোগী শুধু শিশুরা নয়। সব ধরনের রোগীই। (চলবে)
|
স্তন ক্যানসার নিয়ে
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
স্তন-ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে পদযাত্রা শহরে। |
অক্টোবর মাসটি গোটা বিশ্বেই ‘স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস’ হিসেবে চিহ্নিত। এই উপলক্ষে সোমবার এক পদযাত্রার আয়োজন করে এক বেসরকারি ক্যানসার চিকিত্সা কেন্দ্র। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলারা সামিল হন। ছিল বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীরাও। |