সারা দিন সাংসারিক কাজের ফাঁকে রোজ ঠিক সময় বার করে জিম থেকে গলদঘর্ম হয়ে আসেন সল্টলেকের গৃহবধূ শণিতা চন্দ্র।
শু্যটিং-এর ফাঁকে প্রচণ্ড খিদে পেলেও অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় খান কেবল প্রোটিন ড্রিঙ্ক-এর সঙ্গে কয়েকটি বিস্কুট।
এক দিন জাঙ্ক ফুড খেয়ে ফেললে ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল পর পর চার দিন খাবারের বিষয়ে সচেতন থাকেন। এক মহিলা আইপিএস অফিসার প্রতি দিন সকালে এক থেকে দেড় ঘন্টা নিয়ম করে হয় টেনিস খেলেন, না হয় সাঁতার কাটেন।
সম্প্রতি এই দলে যোগ দিয়েছেন বিমানসেবিকারাও। নিয়মিত জিমে যাচ্ছেন তাঁরা, সাঁতার কাটছেন। শুধু ক্যালরি মেপে খাওয়াই নয়, ডায়েটেশিয়ানের কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরামর্শও নিচ্ছেন। বিমানসেবিকাদের এই স্বাস্থ্যসচেতনতা কেবল নিজেদের তন্বী, সুন্দরী ও আকর্ষণীয় কিংবা শারীরিক ভাবে সক্ষম রাখতে নয়, বরং অনেকটাই পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে।
বেসরকারি বিমানসংস্থাগুলি তো বটেই, কেন্দ্রীয় সরকারও ঠিক করেছে, বিমানসেবিকাদের ‘ফিট’ থাকতে হবে। মুখে ঝকঝকে হাসি ও তন্বী চেহারা নিয়ে শুধু যাত্রী পরিষেবা দেওয়াই যথেষ্ট নয়, আকাশে প্রতিকূল অবস্থা দেখা দিলে পরিস্থিতি সামলানোর জন্যও বিমানসেবিকাদের পুরোপুরি শারীরিক ভাবে সক্ষম থাকা দরকার।
বিমান মন্ত্রকের অধীনস্থ ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ)-এর প্রধান অরুণ মিশ্র-র কথায়, “শুধু যাত্রীদের পরিষেবা দেওয়া নয়, বিমান ওড়ার সময়ে জরুরি অবস্থা দেখা দিলে, প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ফিট থাকতে হবে সেবিকাদের। সম্প্রতি খবর আসছিল, বেশ কয়েক জন সেবিকা নিজেদের ফিট রাখতে পারছেন না।” সে জন্য বিমানসেবিকাদের সামগ্রিক ফিটনেসের উপরে জোর দিচ্ছে কেন্দ্র। এত দিন শুধু পাইলটদের ক্ষেত্রে ছ’মাস অন্তর নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করা ছিল বাধ্যতামূলক। ডিজিসিএ-এর নিয়ম মেনেই তা করা হয়।
এ বার ঠিক হয়েছে, দু’বছরে একবার বিমান মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যপরীক্ষা হবে বিমানসেবিকাদেরও। চল্লিশের বেশি বয়স্কাদের ক্ষেত্রে বছরে এক বার শারীরিক সক্ষমতার ওই পরীক্ষা হবে। পাস না করলে আর উড়তে পারবেন না তিনি। সংশ্লিষ্ট বিমানসংস্থা ঠিক করবে তাঁকে অন্য কোনও কাজে নিয়োগ করা হবে, নাকি বরখাস্ত করা হবে। এ রকম পরীক্ষাতেই বছর চারেক আগে দেখা গিয়েছিল, বিমান সেবিকা মধুমিতা বসু ফিট নন। ২০০৯ সালে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। এই নিয়ে এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আইনি লড়াই চলছে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের (এখন এয়ার ইন্ডিয়া)।
এয়ার ইন্ডিয়া থেকে সদ্য স্বেচ্ছা-অবসর নেওয়া বিমানসেবিকা সুস্মিতা বসু বলছেন, “নিয়মিত শরীরচর্চা করা হতো না। প্রতি ছ’মাসে একবার ডাক্তারি পরীক্ষা হতো। সেটা করত সংশ্লিষ্ট বিমানসংস্থা। তার এক মাস আগে থেকে খাওয়া কমিয়ে দিতাম।”
অর্থাৎ বিমানসেবিকাদের একটা বড় অংশ নিয়ম করে যে শরীরচর্চা করতেন এবং খাওয়াদাওয়ার প্রতি খেয়াল রাখতেন, তা নয়। বছরে দু’বার সংশ্লিষ্ট বিমানসংস্থার ডাক্তারি পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার জন্য যে টুকু না করলেই নয়, তাঁরা শুধু সেটুকুই করতেন। কিন্তু সেই ‘শর্টকাট’ আর চলবে না। বেসরকারি বিমানসংস্থার এক সেবিকার কথায়, “ডিউটির বাইরে সময় বার করে নিয়মিত সাঁতার কাটা ও জিম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ডায়েটিং-ও চলছে সেই মতো।”
আসলে সুন্দর নয়, শারীরিক ভাবে সক্ষম থাকাটাকেই মহিলারা মোটের উপর এখন অগ্রাধিকার দিচ্ছেন সমাজের মহিলাদের একটা বড় অংশ। কলকাতা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট গুরুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এখন কলকাতায় পাঁচটি জিম চালান। তাঁর কথায়, “কর্পোরেটে চাকরি করা মহিলা থেকে গৃহবধূ, জিমে সবার সংখ্যাই বাড়ছে। এমনকী, বাড়ছে পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলাদের সংখ্যাও। নিজেকে ফিট রাখলে অনেক রোগ যেমন কাছে ঘেঁষতেই পারছে না, তেমনই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন মহিলারা।” আবার পেশাগত বাধ্যবাধকতা থেকেই নিজেদের শারীরিক ভাবে সক্ষম রাখার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন বিমানসেবিকারা।
শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ডায়েটেশিয়ান ববিতা হাজারিকা জানাচ্ছেন, তিন বছর আগে যা ছিল, এখন তার চেয়ে সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় তিন গুণ মহিলা ফিট থাকার জন্য খাদ্যতালিকায় বদল আনছেন। অভিনেত্রী স্বস্তিকা অবশ্য স্বীকার করেন, সব সময়ে তাঁর পক্ষে নিয়ম মেনে চলা সম্ভব হয় না। তাঁর কথায়, “একেক দিন ইচ্ছা করলে রেস্তোরায় গিয়ে জমিয়ে বসে বিরিয়ানি খাই। কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে নাইট-ক্লাবে গিয়ে দেদার দারু।” স্বস্তিকার মতে, “কর্পোরেটে কর্মরতাই বলুন কিংবা বিমানসেবিকা, একটু পৃথুলা না হলে মহিলাদের মানায় নাকি!”
কিন্তু বতর্মান পরিস্থিতিতে বিমানসেবিকাদের সে টুকু আলগা দেওয়ার সুযোগও থাকছে না! |