সক্কাল সক্কাল কুমোরটুলি থেকে একের পর এক ঠাকুর বেরোচ্ছে।
এ-সব ক্ষেত্রে ছেলেছোকরাদের ‘বলো দুর্গা মাই কি’ ধ্বনি শুনতে আর কোমর দোলানো দেখতে অভ্যস্ত কলকাতা হঠাৎ বিষম ধাক্কা খেল। প্রতিমার মণ্ডপযাত্রা দেখে আত্মহারা নাচে মেতেছেন কারা? পরনে সাদা থান। গলায় তুলসীকণ্ঠি। কপালে তিলক। থুড়থুড়ে ঠাকুমাদের নাচ দেখে আশপাশের অনভ্যস্ত চোখ ছানাবড়া! ঠাকুমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। মুহুর্মুহু ‘জয় রাধে রাধে,’ ‘হরিবোল’ ধ্বনি দিতে দিতে নেচেই চলেছেন দু’হাত তুলে।
কত দিন বাদে দুর্গাঠাকুরকে মণ্ডপে যেতে দেখছেন! কারও ঘরে ফেরা ২০ বছর পরে, কারও বা ৩৫। পার্বতীর পিতৃগৃহে যাত্রার সঙ্গে ওঁদের কেউ কেউ কি নিজেদের বাংলায় ফেরার মিল পাচ্ছেন? দুর্গার তেলতেলে মুখের দিকে তাকিয়ে তাই কি দু’চোখ ছাপিয়ে জল নামল ওঁদের? দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে সেরে নিলেন প্রণাম। তার পরে আবার হরিধ্বনির তালে তালে কাঁদতে কাঁদতে নাচ। হাসতে হাসতে নাচ। তারই মধ্যে কেউ কেউ আবার মাটির হাঁড়িকুড়ির দরদস্তুর শুরু করলেন কুমোরপাড়ার দোকানে। তৃতীয়ার সকালে এ ভাবেই মহানগরে শারদ সফর শুরু করলেন বৃন্দাবন থেকে আসা বৃদ্ধা বাঙালি বিধবারা। |
কুমোরটুলিতে বৃন্দাবনের বৃদ্ধারা। সোমবার। ছবি: সুমন বল্লভ। |
কুমোরটুলি থেকে পরবর্তী গন্তব্য ধর্মতলা এলাকার পাঁচতারা হোটেল। সেখানেও বৃদ্ধাদের তাক-লাগানো ‘পারফরম্যান্স!’ কে বলবে ১৫-২০-৩৫-৪০ বছর এঁরা সংসারজীবন থেকে সম্পর্কচ্যুত! কে বলবে, জীবনে এই প্রথম এঁরা এমন তারামার্কা ঝাঁ-চকচকে পরিবেশে এসে পড়লেন! বয়সের ভারে ন্যুব্জ, একশো পেরোনো গীতা দাসী এত নিপুণ ভাবে ব্যুফের লাইনে দাঁড়িয়ে প্লেট-চামচ হাতে খাবার নিলেন যে, হোটেলের কর্মীরা পর্যন্ত চমৎকৃত।
টেবিল-চেয়ারে বসে কাঁটা-চামচ দিয়ে তরিবত করে খেয়ে ফোকলা মুখে এক গাল হেসে গীতাদেবী বললেন, “ভেবেই এসেছিলুম, কলকাতায় এসে খাঁটি বাঙালি নিরামিষ রান্না খাব। হাত পুড়িয়ে ভাতে-ভাত রেঁধে তো জীবন গেল। এটা ঠিক বাঙালি রান্নার মতো নয়। তবে দিব্যি খেতে হয়েছে।” প্লেট জায়গামতো রেখে আবার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন পরিবেশকদের। পাঁচতারা হোটেলের বলরুমে তখন এক অসাধারণ দৃশ্য। সারি সারি টেবিল আর চার পাশে গোল করে সাজানো চেয়ারে পা উঠিয়ে বাবু হয়ে বসে আছেন সাদা কাপড় পরা আধঘোমটা দেওয়া বয়স্ক মানুষগুলি। মুখচোখ জ্বলজ্বল করছে। ঠিক যেন বিয়েবাড়ি!
স্বপ্নের মতো জীবনযাত্রার এই ক্ষণিক বদল গীতাদেবী, গরবিনী শীল, পুষ্প অধিকারী, সরোজিনী দেবনাথ, যোগমায়া সাহা, মলিনা দাস, মঞ্জরী দাসী, আঙুরবালা, অন্নদাসুন্দরীদের আদৌ ঘাবড়ে দিতে পারেনি। বিশাল হলঘরে সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরার ভিড়ে মাইক হাতে নিয়ে সপ্রতিভ ভাবে ‘সাংবাদিক সম্মেলন’ করলেন বৃন্দাবন থেকে পুজোর কলকাতায় ঘুরতে আসা বৃদ্ধারা। এক বারও কথা আটকাল না। প্রশ্ন না-ফুরোতেই উত্তর দিলেন ফরফরিয়ে। নাতনির বয়সি সাংবাদিককে পাশে বসিয়ে মহা-উৎসাহে দেখালেন, পুজোয় বেড়াবেন বলে কেমন তুলসীকাঠের নতুন দুল নিজের হাতে বানিয়ে পরে এসেছেন!
পাঁচতারা শৌচাগারের ব্যবহার শিখতে হোটেল-সেবিকাদের ডেকে চোস্ত হিন্দিতে বৃদ্ধারা বললেন, “বেটি, জারা কল চলানা শিখা দো।” শেখানোর পরে আশীর্বাদ। হরিনামে মেতেছে পাঁচতারার হলঘরও।
দুর্গাপুজো উপলক্ষে বৃন্দাবনের এক আশ্রমে আশ্রয়প্রাপ্ত ৫২ জন বাঙালি বর্ষীয়ান বিধবাকে মহানগরে ঘোরাতে এনেছে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বছর ষাটের গরবিনীদেবীর বাড়ি ছিল বনগাঁর রেলবাগানে। জানালেন, সেই সময় মিটিং-মিছিল করতে এসেছেন কলকাতায়। স্বামীর সঙ্গে ঠাকুর দেখতেও এসেছিলেন। মিছিলে এসে রাস্তা থেকে এই পাঁচতারা হোটেলটি দেখেছিলেন, মনে আছে। বললেন, “শ্রীকৃষ্ণের কৃপা ছাড়া ছেঁড়া কাঁথা থেকে এই রকম রাজপ্রাসাদে আসা যায়, বলো? কখনও ভাবিনি, প্লেনে চড়ব, হোটেলে থাকব।” হইহই করে হোটেলটাও ঘুরে দেখেছেন সবাই। কোথায় কোথায় আর কী করা উচিত, পরামর্শও দেন হোটেলের কর্মীদের।
কাঁকুড়গাছির যে-হোটেলে ওই বৃদ্ধাদের তোলা হয়েছে, সেখানকার কর্মীরাও ‘মাইজিদের’ তত্ত্বাবধানে ব্যস্ত। বৃদ্ধাদের কেউ কেউ নিজের ঘরে নিজে রেঁধে খাবেন, কেউ আবার খাবারে নুন খাবেন না। সব খেয়াল রেখেছেন হোটেল-কর্মীরা। কমলা দাসী, গায়ত্রী দাসীরা হোটেল-কর্মীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বললেন, “অনেক করছে ওরা আমাদের জন্য।”
বেশ কয়েক জন বৃদ্ধার আত্মীয়েরা দেখা করতে এসেছিলেন। খুব একটা পাত্তা দেননি বৃদ্ধারা। কেউ কেউ গীতা আউড়ে বলেছেন, “পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। সব মোহ। বরং এই দিব্যি আছি আমরা। জয় রাধে।”
আমরাও আছি। দিনভর নেচে-গেয়ে-হেসে-কেঁদে নগর দাপিয়ে বার্তা দিলেন বৃন্দাবনের বৃদ্ধারা।
|