এক বার নয়, গাড়িটা তিন বার ধাক্কা মেরেছিল লেকটাউনের ক্যানাল স্ট্রিটের ছ’বছরের শুভম শর্মাকে। শনিবার বেলা এগারোটা নাগাদ যখন দুর্ঘটনাটি ঘটে, তখন শুভমের খুব কাছে ছিলেন শঙ্কর মাকাল নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। রবিবার ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময়েও তাঁর চোখে-মুখে আতঙ্ক।
শঙ্কর বলেন, “দুর্ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন শ্রেয়া সর্বাধিকারীর গাড়ির চালক পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। গাড়ি গ্যারাজে ঢোকানোর চেষ্টা করছিল শ্রেয়া। তা করতে গিয়ে এক বার নয়, তিন বার শুভমকে ধাক্কা মেরেছে মেয়েটা।” শঙ্কর জানান, প্রথম বার যখন গাড়িটা পিছনে গড়িয়ে ধাক্কা মারে তখন শুভমের পায়ে লেগেছিল। সেই ধাক্কায় শুভম পড়ে যায়। শঙ্কর বলেন, “ওকে ওখান থেকে তুলতে যাচ্ছিলাম। তখনই গাড়িটা ফের গড়িয়ে পিছোতে শুরু করে। এ বার শুভমের বুকে ধাক্কা লাগে। আমরা সবাই মিলে চিৎকার করে উঠি। একটু এগিয়ে গাড়িটা ফের পিছিয়ে শুভমকে ধাক্কা মারে। পিছনের দেওয়ালের সঙ্গে পিষে যায় শুভম।” পরে ওই শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হয় এলাকার একটি নার্সিংহোমে। চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ঘটনার পরে পুলিশ গ্রেফতার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ২৩ বছরের শ্রেয়াকে।
তদন্তে পুলিশ জানিয়েছে, শ্রেয়া দু’বছর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন। এলাকার বাসিন্দারা জানান, শ্রেয়ার যে লাইসেন্স রয়েছে, তা তাঁরা জানতেন না। কোনও দিন ওই তরুণীকে একা গাড়ি চালাতেও দেখেননি তাঁরা। শঙ্কর বলেন, “মাঝেমধ্যে দেখতাম, ভিআইপি রোডের সার্ভিস রোডে চালককে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালানো অভ্যেস করছে। পাড়ার ছোট্ট গলিতে ওকে কোনও দিন গাড়ি চালাতে দেখিনি।”
শঙ্করের সঙ্গে একমত এলাকার বাসিন্দারাও। কিন্তু চালক ঘটনাস্থলে থাকা সত্ত্বেও কেন শ্রেয়া নিজেই গাড়ি গ্যারাজে ঢোকাতে গেলেন? রবিবার দিনভর এই প্রশ্নই তুলেছেন শুভম শর্মার পাড়ার বাসিন্দারা। তাঁদের মতে, ক্যানাল স্ট্রিটের মতো সরু গলিতে গাড়ি গ্যারাজ করতে গেলে পাকা ড্রাইভারকেও রীতিমতো সচেতন থাকতে হয়। সেই দক্ষতা না থাকাতেই এই দুর্ঘটনা বলে মনে করছেন এলাকাবাসীরা।
শুভমের দাদু যমুনা শর্মা বলেন, “গ্যারাজ থেকে যে গাড়ি বার করতে বা ঢোকাতে পারে না, সে হয়ে গেল ড্রাইভার? আমরা জানতাম ওর লাইসেন্স নেই। এখন পুলিশ বলছে, লাইসেন্স আছে। কী ভাবে এ রকম আনাড়ি এক জন লাইসেন্স পায়? এ রকম আনাড়ি মানুষের লাইসেন্স পাওয়া মানে তো খুন করার লাইসেন্স পাওয়া।” শুভমের এক আত্মীয় বলেন, “পাড়ায় কোনও পুজোর আনন্দ নেই। পুজোর জামা হয়ে গিয়েছিল শুভমের। শুধু জুতোটাই কেনা বাকি ছিল। এখন ছেলের সে সব জামাকাপড় আঁকড়ে কান্নাকাটি করছে শুভমের মা।” এ দিন শুভমের ঘরে গিয়ে দেখা যায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মা জ্যোতিদেবী। জ্ঞান হারাচ্ছেন মাঝেমধ্যেই।
শ্রেয়াদের গাড়ির গ্যারাজে পিছনের দিকটা কিছুটা ঢালু। এলাকার এক অভিজ্ঞ চালক বলেন, “ওই গ্যারাজে গাড়ি ঢোকাতে গেলে হ্যান্ড গিয়ার দিয়েই গাড়ি ঢোকানো উচিত। পাকা চালক না হলে গাড়ি পিছনের দিকে গড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ওই মেয়েটি কি হ্যান্ড গিয়ার দিয়েছিল? হ্যন্ড গিয়ার দিলে কিন্তু গাড়ি গড়িয়ে পিছিয়ে যেত না।”
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। শ্রেয়ার লাইসেন্স থাকলেও কতটা সে চালাতে পারত, তা শ্রেয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে শ্রেয়া যে পাকা চালক নন, সে ব্যাপারে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ, পাকা চালক হলে তাঁকে কেন সর্বক্ষণ এক জন গাড়ির চালককে পাশে বসিয়ে রাখতে হবে? এ দিন শ্রেয়াদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় সেখানে এক বৃদ্ধা ছাড়া কেউ নেই। বাড়ির সামনে বেশ কয়েক জন পুলিশকর্মীর টহলদারি চলছে। শ্রেয়াকে এ দিন বিধাননগর আদালতে তোলা হলে তাঁর জেল হেফাজত হয়।
|