|
|
|
|
পিছু ছাড়ছেন না বরুণদেব, ঘোর চিন্তায় পুজোর বাঙালি |
কুন্তক চট্টোপাধ্যায় |
টানা বৃষ্টির জেরে তখন কার্যত জল থইথই দক্ষিণ কলকাতার মণ্ডপটির সামনের রাস্তা। তার মধ্যেই হাজির হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্বোধনের মঞ্চ তখন ভিজে সপসপ করছে। তাই ঢুকে গেলেন মণ্ডপে। সেখান থেকে মাইকে বললেন, “বৃষ্টিটা কমিয়ে দাও মা। এটাই প্রার্থনা।”
কয়েক দিনের নাছোড় বৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে আম-বাঙালির মনের কথাই যেন বলে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু আপাতত চতুর্থী পর্যন্ত কোনও আশার আলো দেখাতে পারছে না আবহাওয়া দফতর, যাতে স্বস্তি আসে পুজো উদ্যোক্তা থেকে আম বাঙালির মনে।
কী বলছেন আবহবিদেরা? তাঁরা জানান, গত শনিবার বঙ্গোপসাগরের ওড়িশা-বাংলা উপকূলে তৈরি হওয়া নিম্নচাপটির রেশ কাটতে না কাটতেই ফের দক্ষিণবঙ্গের উপরে থাকা
মৌসুমি অক্ষরেখা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই শুরু হয়েছে বর্ষার দাপট। এ দিনের বৃষ্টির পিছনেও দায়ী সেই মৌসুমি অক্ষরেখাই।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানান, মৌসুমি অক্ষরেখা সক্রিয় থাকার ফলেই বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হয়েছে। যা থেকে কলকাতা ও সংলগ্ন দক্ষিণবঙ্গে এমন বৃষ্টি। আবহবিদদের মতে, আপাতত যা পরিস্থিতি, তাতে চতুর্থী পর্যন্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ঘটনাচক্রে, দক্ষিণবঙ্গে নিয়মমাফিক বর্ষার ক্যালেন্ডার শেষ হচ্ছে সে দিনই। এ বছর দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা হাজির হয়েছিল কাঁটায় কাঁটায় নির্ঘণ্ট মেনে। একই ভাবে সে বিদায় নেবে কি না, তা কিন্তু এখনই বলতে পারছেন না আবহবিজ্ঞানীরা। |
মাথা বাঁচাতে। কুমোরটুলি থেকে মণ্ডপের পথে। শনিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক। |
এই অবস্থায় কপালে ভাঁজ বহু পুজো উদ্যোক্তার। এ দিন রাজ্যের নতুন প্রশাসনিক ভবন নবান্নয় বসে মেঘলা আকাশ দেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী আর পেয়েছেন উদ্বোধনের দিন পিছিয়ে দেওয়ার বিস্তর অনুরোধ। বড় পুজোগুলির বেশির ভাগের কাজ প্রায় শেষ। এখন চাইলেও মণ্ডপে অদলবদল করা সম্ভব নয় তাঁদের পক্ষে। অনেকে আবার পরিবর্তনের পক্ষপাতীই নন। এ দিন যে পুজোর উদ্বোধনে গিয়েছিলেন মমতা, সেই ৯৫ পল্লির শিল্পী সনাতন দিন্দা মণ্ডপ সাজিয়েছেন শালপাতার তৈরি বাটি দিয়ে। বৃষ্টি হলেও সেখানে কোনও কিছু পরিবর্তন করছেন না সনাতন। যেমন, পরিবর্তনপন্থী হতে পারছেন না শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্লাব, নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজোর শিল্পী ভবতোষ সুতারও। তিনি জানালেন, নাকতলায় প্রতিমার মূল মণ্ডপ বাদে পুরোটাই খোলা জায়গা। প্রতিপদের দিন দাঁড়িয়ে আর কোনও বদলের অবকাশ নেই।
বেহালা নূতন দল কিন্তু বিপাকে। শিল্পী রণো বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রাম তুলে আনছেন সেখানে। বৃষ্টিতে কাদা হয়ে গিয়েছে গাঁয়ের উঠোনে। যদিও রণোর দাবি, “মণ্ডপের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি।”
কাজ বাকি রয়েছে দক্ষিণ কলকাতার শিবমন্দির এবং ট্যাংরা ঘোলপাড়াতেও। দুই পুজোরই শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। বলছেন, বৃষ্টির দাপটে অনেক কাজই করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ট্যাংরায় বেশ কিছু মাটির কাজ বাকি রয়েছে। শিবমন্দিরের ভিতরের কাজ সম্পূর্ণ হলেও বৃষ্টির দাপটে কয়েক দিন ধরেই বাইরের কাজ করা যাচ্ছে না। এমন বৃষ্টি চলতে থাকলে ওই দু’টো পুজোয় সামান্য অদলবদল করতে পারেন সুব্রত।
এ তো গেল বড় পুজোর কথা। বৃষ্টিতে সব থেকে বেশি বিপাকে পড়েছেন ছোট ও মাঝারি পুজোর উদ্যোক্তা এবং শিল্পীরা। উদ্বোধনের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ঝড়ের গতিতে কাজ চালিয়েও তাঁরা কিন্তু নিশ্চিত নন, সময়মতো সব শেষ করতে পারবেন কি না। শনিবারের তুমুল বৃষ্টি তাঁদের আরও খানিকটা নাড়িয়ে দিয়েছে।
শিল্পীরা জানান, মহালয়া পেরিয়ে গেলেও অনেক মণ্ডপেই রঙের কাজ করা যায়নি। লেক গার্ডেন্স পিপলস অ্যাসোসিয়েশনেও দুপুরে কাজ শুরু করেছিলেন শিল্পী দীপক ঘোষ। কিন্তু বৃষ্টি নামতেই কাজ বন্ধ করা হয়। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি থামতে ফের কাজ শুরু করেন শিল্পী। এ বার বেহালা ম্যান্টনের প্রগতি সঙ্ঘের থিম বাউল। মণ্ডপের সামনে বিশাল একতারার রঙের কাজ করতে না পেরে বসে ছিলেন শিল্পীরা। টাকা ও সময় নষ্টের ভয়ে মাথায় হাত পুজোকর্তাদের।
এ দিন বাজ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কালীঘাটের একটি পুজো মণ্ডপ। বৃষ্টির জেরে খিদিরপুর, এলগিন রোড ও শম্ভুনাথ পণ্ডিত রোডে জল জমার সেই পরিচিত ছবি। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে ৮৪.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে এর বাইরে উৎসুক বাঙালিকে প্রায় সারাদিনই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সেই প্রশ্নটা, পুজোর চার দিনও কি...? আট বছরের শৈশব পুজোর নতুন জামা নিয়ে চিন্তায়, আর আঠারোর যৌবনকে ভাবাচ্ছে মহাষ্টমীর রাত। |
ছাতা নিয়েই পুজোর বাজারে। শনিবার ধর্মতলায়। ছবি: প্রদীপ আদক। |
চলতি মরসুমের শুরু থেকেই কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে দরাজ মেজাজে রয়েছে বর্ষা। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গোটা রাজ্যে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। তবে অগস্টের শেষ দফা থেকেই বৃষ্টির দাপট বেড়েছে। শেষ লগ্নেও ঝোড়ো ব্যাটিং করছে বর্ষা। শনিবার তার আরও একটা ঝলক দেখা গেল।
এই বৃষ্টির জন্যই এ দিন কুমোরটুলি থেকে অনেক প্রতিমা মণ্ডপের উদ্দেশে রওনা দিতে পারেনি। হাতে গোনা যাঁরা এর মধ্যেই প্রতিমা নিয়েছেন, তাঁদের ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছে বিস্তর। মূর্তি ঢাকতে হয়েছে প্লাস্টিকে। কুমোরটুলির প্রতিমা শিল্পীরা জানিয়েছেন, অনেকেরই ঠাকুর তৈরির কাজ শেষ হয়েও হচ্ছে না। দিতে পারছেন না তুলির শেষ প্রলেপ।
বৃষ্টির জন্য মার খেয়েছে পুজোর বাজারও। পুজোর আগে শেষ উইক-এন্ডে কেনাকাটা সারতে অনেকেই এসেছিলেন নিউ মার্কেট বা গড়িয়াহাটে। যেমন, আগরপাড়ার সঞ্চিতা দত্ত ও ছন্দা মজুমদার। মেঘলা আকাশ দেখে ভেবেছিলেন, রোদ নেই, মনোরম আবহাওয়ায় বাজার করবেন। কিন্তু মেট্রো থেকে বেরিয়েই দেখেন, অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সঙ্গে ছিল না ছাতাও। তা-ই মেট্রোর সিঁড়িতে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পরে ভিজে ভিজেই নিউ মার্কেটে গেলেন তাঁরা।
তবে এই শহরে বরুণদেবের কৃপাধন্য কিছু পুজোও রয়েছে। কাজ পণ্ড হওয়া তো দূরের কথা, উল্টে বৃষ্টির দাপটে যেন মণ্ডপের জৌলুসই বেড়ে গিয়েছে! অন্তত তেমনই দাবি পুজোকর্তাদের। যেমন, নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘে সাজিয়ে তোলা ম্যানগ্রোভ অরণ্য আরও ঝকঝকে হয়েছে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে উত্তর কলকাতার কাশী বোস লেনের পুজোয় ধবধবে সাদা হয়ে ‘ফুটেছে’ কাশফুল। তবে ওই পুজোর কর্তারা মাথা ঘামাচ্ছেন বিদ্যুতের তার নিয়ে। পুজো কমিটির তরফে সোমেন দত্ত বলেন, “দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বৈদ্যুতিক তার মাটির তলা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কাদা এড়াতে মাঠে থাকছে সিমেন্ট ঢালাই।” ভবানীপুর অগ্রদূত সঙ্ঘের মণ্ডপের অনেকটা জুড়ে রয়েছে পিভিসি পাইপ। বৃষ্টি বেকায়দায় ফেলতে পারেনি তাদেরও।
বৃষ্টির শহরে নাজেহাল সকলের মধ্যে এঁরাই ব্যতিক্রম।
|
সহ-প্রতিবেদন: অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও রোশনী মুখোপাধ্যায়
|
এই সংক্রান্ত আরও খবর... |
• মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরি সারাদিন, ছাতা নিয়েই চলছে কেনাকাটা |
পুরনো খবর: দেবীপক্ষের শুরুতেও সেই বৃষ্টিই ‘অসুর’ |
|
|
|
|
|