কাবুলে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তালিবানের ১ নম্বর নিশানা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার রাজকুমার হ্যারি। এক তালিবান নেতার বয়ানে প্রকাশ্যে এল সে সত্য।
ঘটনাস্থল উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ার। চারিদিকে আঁটোসাটো নিরাপত্তা বেষ্টনী। ভিতরে কোনও ভিভিআইপি নেই। বরং বসে রয়েছেন তালিবান নেতা, কারি নাসরুল্লা। ওই গোপন সাক্ষাৎকারেই তিনি একটি ব্রিটিশ দৈনিককে জানালেন বেশ কয়েক বার নিশানা করা হয়েছিল হ্যারিকে। হয় মেরে ফেলা হত কিংবা অপহরণ। গোটা দুনিয়ার কাছে সেটা হতো একটা বার্তা। স্রেফ ভাগ্যের জোরে বেঁচেছেন হ্যারি।
গত বছর সেপ্টেম্বরে শেষ বার আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন হ্যারি। সেটা ছিল ডায়ানা-পুত্রের দ্বিতীয় সফর। বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে কয়েকশো মাইল দূরে আফগানিস্তানের ধু ধু প্রান্তরে সেনা ছাউনিতে থাকা অভ্যেস করেছিলেন তিনি। তালিবানের ফতোয়া, জঙ্গি হানা, আত্মঘাতী বিস্ফোরণ সবই চিনেছিলেন ধীরে ধীরে। বহু বার জঙ্গিদের মুখোমুখিও হয়েছিলেন হ্যারি, বেঁচে যান কোনও মতে। শেষ বার হ্যারি আফিগানিস্তানে পৌঁছনোর কয়েক দিনের মাথায়, বাসতি-র ব্রিটিশ ক্যাম্পে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটে। পরে এক বার তালিবানের ১৫ জনের একটি দল দুই মার্কিন সেনাকে হত্যা করে। ধ্বংস করে দেয় বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান-হেলিকপ্টার। এই গোটা সময়টাই হ্যারি ছিল আফগানিস্তানে। নাসরুল্লার ব্যাখ্যায় ক্রমশ বদলাচ্ছে সে দিনগুলোর ঘটনা আর তার অন্তরালে কারণ।
কয়েক মাস ধরে বারবার সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এসেছে তালিবান প্রসঙ্গে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি। দুই রাষ্ট্রই তালিবানের সঙ্গে সমঝোতার পথে হাঁটতে চাইছে। কিন্তু কী ভাবছে তারা?
নাসরুল্লার কাপড়ে ঢাকা মুখটায় শুধু চোখদু’টো দেখা যাচ্ছিল। ভদ্র, নম্র ব্যবহারের আড়ালে ঠিকরে বেরোচ্ছিল ক্ষিপ্রতা। বলেন, “ব্রিটিশ রাজকুমার এলেন আমাদের এখানে, হেলিকপ্টার চালালেন, বোমা ছুড়ে আমাদের যোদ্ধাদের মারলেনও কিন্তু ভাববেন না রাজকুমার বলে আমরা তাঁকে ছেড়ে দিয়েছি।” নাসরুল্লার কথায়, “আমাদের যোদ্ধাদের চোখে ও নেহাতই এক জন সেনা। আমেরিকার হয়ে লড়ছিল। বেঁচে গিয়েছে শুধুমাত্র ভাগ্যের জোরে। না হলে ওকে অপহরণ করার জন্য অনেক ছক কষা হয়েছিল। ঠিক কোনও না কোনও ভাবে বেঁচে গিয়েছে।”
সাংবাদিকতার সূত্রে আফগানিস্তান কি পাকিস্তানে বহু দেশের লোকের আনাগোনা। জঙ্গি হানা-বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে তাঁদের অনেকেরই। সে প্রসঙ্গও উঠে এসেছিল প্রশ্নোত্তর-পর্বে। ওই ব্রিটিশ দৈনিকটিরই এক সাংবাদিক মারা যান ২০১০-এর জানুয়ারিতে। দু’টো পা-ই হারান তাঁর চিত্রগ্রাহক। দোভাষী মারফত সে প্রসঙ্গ তুলে ধরতেই, খানিকটা ভাটা পড়েছিল নাসরুল্লার ক্ষিপ্রতায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। তার পর গলাখাকারি দিয়ে বলেন, “বহু বিদেশি সাংবাদিক এখানে আসেন। তালিবান জমানায় তাঁদের অনেকের সঙ্গেই সুসম্পর্ক ছিল আমাদের। অনেকে তো ধর্ম-পরিবর্তনও করে ফেলেছিলেন। আমাদের শাসনকালে যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হত সাংবাদিকদের। এখন যুদ্ধ-পরিস্থিতি, কোনও দায় নিতে পারব না।”
কিন্তু প্রতি বছর এই ‘যুদ্ধেই’ তো কত আফগানের মৃত্যু হয়?
সে কথায় নাসরুল্লা বলেন, “গোটা দুনিয়া জানে, বিদেশি শক্তি আমাদের দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিয়ে থেকে শোকসভা, সাধারণ মানুষের বসবাস সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের হাতে মরে তারাই, যারা ন্যাটোর কাছাকাছি থাকে, ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে।” যোগ করেন, “আমাদের ভুলে এক জনও মরলে দুনিয়ার কাছে সেটা খবর, কিন্তু আমেরিকা যখন আফগানদের মারে...?”
এত কিছু মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যখন সরগরম, রাজকুমার হ্যারি সিডনিতে। অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনীর অনুষ্ঠানে রানির প্রতিনিধি তিনি। রাজকুমারকে ঘিরে দারুণ উচ্ছ্বাস। তিনি হয়তো জানেন না, পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে তিনি নেহাতই এক সেনা। যিনি আমেরিকার হয়ে লড়েছিলেন মাত্র। |