সপ্তমীর সকালে কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলে স্কুলের পোশাকে কচিকাঁচাদের দেখে অবাক অনেকেই। পড়ুয়াদের হাতে ছাপানো ফর্ম। তাতে বলা হয়েছে, পুজোর সময়ে পরিবেশের উপর বাড়তি চাপ কী কী। আর এর প্রতিকারেই কী কী করা উচিত, তা নিয়ে বড়দের পরামর্শ চেয়েছিল ছোটরা।
ঠিক ১৩ বছর আগে, ২০০০ সালের শারদোৎসবে এ ভাবেই গল্ফগ্রিন এলাকায় স্কুলপড়ুয়ারা বাড়িতে-বাড়িতে, ফ্ল্যাটে-ফ্ল্যাটে গিয়ে বড়দের জানিয়েছিল, উঁচু প্রতিমা আনার সুবিধা ও আলোকসজ্জার জন্য অবাধে কাটা হচ্ছে গাছের ডাল, বিকট আওয়াজে মাইক বেজে চলেছে অনবরত, গাছের গায়ে আলোকসজ্জায় গাছের বৃদ্ধি নষ্ট হচ্ছে ও ক্ষতি হচ্ছে জীববৈচিত্রের, প্রতিমার গায়ের রঙে থাকা সীসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো ধাতু বিসর্জনের পরে নদী ও জলাশয়ের দূষণ ঘটাচ্ছে। বড়রা তখনও এই সমস্ত দিক সে ভাবে ততটা ভাবেননি। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগ তাই এগিয়ে দিয়েছিল ছোটদের।
আর এখন, ওই উদ্যোগের ১৩ বছর পরে কলকাতা জুড়ে বারোয়ারি পুজোয় মোটের উপর পরিবেশের এই দিকগুলোতেই সবাই খেয়াল রেখে চলছেন। কলকাতার ৫১টি বারোয়ারি পুজো এবং সল্টলেক ও দমদম মিলিয়ে মোট ২৫টি পুজোয় বসছে পরিবেশবান্ধব পোর্টেবল শৌচাগার। বিমানে যেমন থাকে, তেমন ভাবে তৈরি ওই শৌচাগারে ৪০০ লিটারের বর্জ্য ট্যাঙ্ক রয়েছে। আমেরিকা থেকে যিনি ওই ‘সবুজ-শৌচাগার’ এনে সরবরাহ করছেন, সেই বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, “চার ফুট বাই চার ফুটের প্রতিটি শৌচাগারের উচ্চতা সাড়ে সাত ফুট। ওয়াশিংটন-সহ পশ্চিমের বিভিন্ন শহরের পার্কে এ রকম শৌচাগার রয়েছে।”
পুজোকে সামগ্রিক ভাবে পরিবেশ-বান্ধব করতে চেয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন যিনি, পরিবেশকর্মী সেই সুভাষ দত্তও মানছেন, “গাছের ডালপালা আনাড়ি হাতে নির্বিচারে কাটার উপরে নিয়ন্ত্রণ এসেছে। তা ছাড়া, কলকাতার বারোয়ারি পুজোর ৯৫ শতাংশই বসতি এলাকায়। সে দিকে লক্ষ রেখে মাইক ব্যবহারেও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল। সেটাও হয়েছে।” তবে সুভাষবাবু মনে করেন, “বিসর্জনজনিত দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এক রকম বিপ্লব হয়েছে। গঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার পরেই কাঠামো ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ক্রেন দিয়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে পুরসভা। কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষও এতে সামিল হয়েছেন। বিসর্জনের ফলে গঙ্গা দূষণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে।”
আর এক পরিবেশকর্মী ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “দুর্গাপুজোর মতো সামাজিক উৎসবকে পরিবেশবন্ধু করে তোলার এক রকম নির্দেশিকাই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বছর আটেক আগে ঠিক করে দিয়েছিল। প্রতিমার গায়ে সীসা ও ক্যাডমিয়ামবিহীন রঙের ব্যবহার বন্ধ করা, মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণপরিবেশবান্ধব এই সব ব্যবস্থা নিতে পর্ষদই পথ দেখিয়েছে।” বিশ্বজিৎবাবু জানান, পরিবেশ রক্ষা করে চলা পুজোগুলির জন্য ২০০৬ থেকে ‘সেরাদের সেরা নির্মল পুজো পুরস্কার’ চালু করেছিল পর্ষদ ও রাজ্য পরিবেশ দফতর। যদিও বছর দুয়েক যাবৎ ওই পুরস্কার বন্ধ রয়েছে। গত দু’বছর পর্ষদ পরিবেশ-অনুকূল সেরা পুজোগুলিকে ‘গ্রিন অ্যাওয়ার্ড’ দিলেও এ বছর তা দেওয়া হচ্ছে না।
২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে শারদোৎসবের মুখে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তদানীন্তন চেয়ারম্যান এস পি গৌতম কুমোরটুলি ঘুরে দেখে ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দফতরে বিসর্জনের ভিডিও ফুটেজ দেখে মন্তব্য করেন, কলকাতার প্রতিমা তো বটেই এবং সেই সঙ্গে বিসর্জনের পদ্ধতি দেশের মধ্যে সব চেয়ে পরিবেশ-বান্ধব। তাঁর বক্তব্য ছিল, খড়-মাটি-কাঠ-বাঁশ দিয়ে তৈরি কাঠামো সহজেই প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। আর বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই এখানে প্রতিমা জল থেকে তুলে নেওয়া হয়।
পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারের বক্তব্য, “পুজোয় প্লাস্টিকের ব্যবহারও কমেছে। আসলে মানুষ এগিয়ে এসেছেন। পরিবেশ নিয়ে প্রচার-আন্দোলন পুজোকে উপলক্ষ করে চালিয়ে গেলে আগামী দিনে আরও লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হবে।”
পরিবেশ সচেতনতা ও পরিবেশ নিয়ে প্রচারকে পুজোর থিমে আনার রেওয়াজও চালু হয়েছে কলকাতায়। এক সময়ে যেমন থিমের অভিনবত্বের দিক দিয়ে একে অন্যকে টেক্কা দিতে নামত বারোয়ারি পুজোগুলি, ইদানীং তেমন পরিবেশ বান্ধব হওয়ার ক্ষেত্রে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার লড়াই শুরু হয়েছে। এ বছর হাতিবাগান নবীনপল্লিতে ধাতু দিয়ে তৈরি হয়েছে প্রতিমা ও মণ্ডপ। বিসর্জনের কোনও ব্যাপার নেই বলে দূষণের ঝুঁকিও নেই এ ক্ষেত্রে। আবার পাথর খোদাই করে প্রতিমা তৈরি করছে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ, কাঠ খোদাই করে প্রতিমা তৈরিতে নেমেছে বোসপুকুর শীতলামন্দির। উত্তর কলকাতার কাশী বোস লেনের মতো ঘিঞ্জি জায়গাতেও এ বার কাশফুল, ঘাস, বেলপাতার সমন্বয়ে পুজো ‘প্রকৃতির কোলে’।
২০০৯ থেকে পরপর চার বছর কখনও বৃক্ষরোপণ, কখনও বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, কখনও পাহাড় বাঁচানো ও সমুদ্র দূষণ সম্পর্কে ‘থিম’ তৈরি করা সুরুচি সঙ্ঘের পুজোর মুখ্য সংগঠক তথা রাজ্যের আবাসন ও যুবকল্যাণমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেন, “পুজোর মুখে বৃষ্টির প্রকোপে অনেক পুজোরই বাজেট এক লাফে বেড়ে যায়। এটা আটকাতে পুকুর বোজানো ও গাছ কাটার বিরুদ্ধে পুজোর কর্মকর্তাদের সচেতন হওয়া উচিত।”
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের দিকেও আলাদা নজর দিচ্ছে অনেক বারোয়ারিই। অল্প হলেও পুজোর সজ্জায় সৌরশক্তির আলোর ব্যবহার শুরু হয়েছে। শিবমন্দির বারোয়ারির সংগঠক পার্থ ঘোষ বলেন, “মণ্ডপের ভিতরে সব আলো তো বটেই, এমনকী মণ্ডপের বাইরেও বেশির ভাগ সজ্জাতেই আমরা এলইডি ব্যবহার করি।’’
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের মতে, “একটা দিক এখনও অবহেলিত। পুজোর ক’টা দিন যে সব বারোয়ারি পরিবেশের কথা ভাবে ও প্রচার করে, তাদের অনেকেরই ভাসানের মিছিলে শব্দমাত্রা অতিক্রম করে যায় যাবতীয় সীমাকে। একই সঙ্গে মাইক ও শব্দবাজির ব্যবহারে মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে।” বস্তুত, পরিবেশ নিয়ে এত রকম উদ্যোগের কার্যত বিসর্জন হয় প্রতিমা বিসর্জনের মিছিলে। |