বোধনের সুর পশ্চিমে, পূর্বে যেন বিসর্জন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
এক দিকে বেজে উঠেছে আবাহনের বাঁশি। অন্য দিকে যেন বিসর্জনের বাদ্যি।
আজ বাদে কাল দেবীপক্ষের সূচনা। আর পরশু, শনিবার থেকে গঙ্গা পেরিয়ে নতুন সচিবালয়ে যেতে শুরু করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য প্রশাসনের নতুন সদর ‘নবান্ন’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও হবে সে দিন। বিভিন্ন দফতরের তাবড় কর্তারা অবশ্য আজ, বৃহস্পতিবার পশ্চিম পাড়ের নয়া ঠিকানায় পা বাড়াচ্ছেন। পূর্ব পাড়ের মহাকরণের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বন্ধন ছিন্ন করে তাঁদের সঙ্গে ঠাঁই বদলাতে চলেছেন বিশাল কর্মীকূলেরও বড় অংশ। |
|
ব্যস্ততা ‘নবান্ন’র সামনে। বুধবার রাতে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার। |
তাঁদের স্বাগত জানাতে নবান্ন’য় তুঙ্গ ব্যস্ততা। আর বিদায়লগ্নে মহাকরণের অলিন্দ কার্যত ভাঙা হাট। বস্তুত হাওড়া মন্দিরতলার নতুন সচিবালয় ভবনে মুখ্যমন্ত্রীর পদার্পণের আগেই যাতে গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম চালু করে দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে বুধবারই কিছু দফতরের কর্মী-অফিসারেরা সেখানে অফিস শুরু করে দিয়েছেন। যেমন কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের সচিব অজিতরঞ্জন বর্ধন জানিয়েছেন, এ দিন সকালে কিছুটা সময় মহাকরণে কাটিয়ে বিকেল থেকে তিনি পাকাপাকি ভাবে নবান্নতেই বসছেন।
আগমনীর সুরে সুর মিলিয়ে সেজে উঠছে নতুন সচিবালয়ও। নবান্ন-সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতে অর্থ, পূর্ত, কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের নথি-ফাইল-চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি পৌঁছে গিয়েছে। এ দিন সেগুলো বিভিন্ন তলায় সাজানো হয়েছে। ঘষে-মেজে সাফসুতরো করে তোলা হচ্ছে নতুন বাড়ির মেঝে ও কাচের জানলা। অর্থ দফতরের এক কর্তা জানান, তাঁদের অধিকাংশ অফিসার-কর্মীর ঠাঁইবদল হচ্ছে আজই। এক পূর্ত-কর্তার দাবি, তাঁদের প্রায় সব ফাইল মহাকরণ থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। আজ, বৃহস্পতিবার নবান্নে কাজ শুরু করবে মন্ত্রিসভা সচিবালয়ও। মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র-সচিব অবশ্য যাবেন শনিবার, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। |
|
আগমনীর দিনভর
(নবান্নে) |
|
সাড়ে ৯টা এলেন পূর্ত ইঞ্জিনিয়ারেরা, পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স |
১০টা মেটাল ডিটেক্টর লাগানো শুরু। ঘুরে গেলেন কর্মিবর্গ দফতরের সচিব |
১০টা ২৫ শুরু হল ঘর গোছানো, জানলার কাচ মোছা |
১১টা.৪৫ কলকাতা পুলিশের তিন কর্তা ১৪-১৫ তলায় |
১২টা-পূর্তসচিবের পরিদর্শনআড়াইটে |
৩টে বকেয়া কাজের তালিকা তৈরি হল |
৪টে লিফ্ট চালু করে বাজানো হল রবীন্দ্রসঙ্গীত |
সাড়ে ৪টে মুখ্যমন্ত্রীর ঘর সাজাতে এল বাহারি ফুলের টব |
|
সরকারি সূত্রের খবর: মহাকরণ চত্বরে মন্ত্রী-অফিসার-অতিথিদের জন্য প্রায় ছ’শো গাড়ি রাখার ব্যবস্থা ছিল। নতুন সচিবালয় ভবনেও তা-ই থাকছে। ফলে কর্তাদের নবান্ন’র সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে তেমন অসুবিধে হবে না। যদিও সে জন্য আম-কর্মীদের আপাতত বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে বলেই আশঙ্কা দানা বেঁধেছে প্রশাসনের অন্দরে। কেন?
সরকারি সূত্রের মতে, এর প্রধান কারণ, পুরনো এইচআরবিসি ভবন বা অধুনা নবান্ন’র সামনে রাস্তাটির সঙ্কীর্ণতা। পরিবহণ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, দ্বিতীয় হুগলি সেতু ধরে যাওয়া বাসগুলির নবান্নের কাছাকাছি পৌঁছতে তেমন বেগ পেতে হবে না। কিন্তু যাঁরা হাওড়া স্টেশন থেকে যাবেন, তাঁদের অসুবিধে হতে পারে। “ব্যাতাইতলার পরে রাস্তা যথেষ্ট সরু। তাই হাওড়া থেকে যাওয়া বড় বাস ব্যাতাইতলায় গিয়ে থেমে যাবে। সেখান থেকে নবান্ন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য বিশেষ শাট্ল গাড়ির বন্দোবস্ত করছে পরিবহণ দফতর।” এ দিন বলেন মহাকরণের এক কর্তা। সমস্যার সুরাহায় কী করা হচ্ছে? |
|
বিদায়ের সারা দিন
(মহাকরণে) |
|
১০টা অর্থমন্ত্রী ও অর্থসচিবের ঘর খালি করা শুরু |
১১টা এলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় |
১১টা ৫ গাঁধীর ছবিতে মালা দিলেন সুব্রতবাবু |
সওয়া ১১টা অর্থসচিব ঢুকলেন |
সাড়ে ১১টা কাজ দেখতে এলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র |
১১টা-৪টে ডিজি-র অফিস, ভূমি ও কর্মিবর্গ দফতরের ফাইল স্থানান্তর |
|
পরিবহণ-সূত্রের বক্তব্য, নবান্ন’র পাশে একটি বাসডিপো বানানো শুরু হয়েছে। কাজ এখনও শেষ হয়নি। এক কর্তার কথায়, “গত ক’দিনের লাগাতার বৃষ্টিতে সব ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছে। আশা করছি, আর বৃষ্টি না-হলে শনিবারের মধ্যে বেশির ভাগ কাজ সেরে ফেলা যাবে।” কিন্তু বাসডিপো হলেও তো সরু পথের ঝামেলা মিটবে না! বড়জোর বিদ্যাসাগর সেতু ধরে আসা লোকজনের সুবিধে হবে। অন্যদের ক্ষেত্রে?
কর্তাটির আশ্বাস, “সেটাও আমাদের মাথায় আছে। অপরিসর রাস্তা কী ভাবে চওড়া করা যায়, তা ভেবে দেখা হবে।”
নতুন সচিবালয় রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাতেও কিছুটা রদবদল হচ্ছে। মহাকরণ দেখভালের দায়িত্ব যেমন পুরোপুরি সরকারি কর্মীদের হাতে ছিল, নবান্নে তেমনটা থাকছে না। সেখানে রক্ষণাবেক্ষণের ভার দেওয়া হচ্ছে এক বেসরকারি সংস্থাকে, যারা কলকাতা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করে কাজ করবে। এ দিকে নবান্ন’র নিরাপত্তার ভার এ দিনই হাতে তুলে নিয়েছে কলকাতা পুলিশ। |
|
নবান্নতে স্থানান্তরিত হচ্ছে অফিস। অর্থ দফতরের সরঞ্জাম সেখানে
সরানোর তোড়জোড়। বুধবার মহাকরণে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক। |
সরকারি সূত্রের খবর, মহাকরণের সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার-কর্মীদের সিংহভাগকে নবান্ন’য় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নয়া সচিবালয়ের বাইরের আইন-শৃঙ্খলারক্ষার দায়িত্ব হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের। আবার ট্র্যাফিক সামলাবে কলকাতা পুলিশ। মঙ্গলবার থেকেই এইচআরবিসি ভবনের আশপাশের একশো মিটার এলাকা জুড়ে জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা।
প্রস্তুতির অন্তিম লগ্নে এ দিন মন্দিরতলায় নতুন সচিবালয়ের সামনে ছিল পুলিশ-প্রশাসনের ঢালাও নিরাপত্তা-আয়োজন। বিদ্যাসাগর সেতু অ্যাপ্রোচ রোডের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের পাহারাও বসে গিয়েছে। বাড়িতে প্রবেশ-নির্গমনে কলকাতা পুলিশের ‘প্রবল’ কড়াকড়ির জেরে এ দিন পরিচয়পত্র ছাড়া কোনও অফিসার বা কর্মী ঢুকতে পারেননি। এমনকী, নিরাপত্তার খাতিরে এ দিন ভবনের ভিতরে কর্মরত কর্মী-শ্রমিকদেরও পরিচয়পত্র বিলি করা হয়েছে। |
|
গন্তব্য নবান্ন |
|
সিটিসি |
টি-২ বিবাদী বাগ-রবীন্দ্র সদন-দ্বিতীয় সেতু-মন্দিরতলা
(১৫ মিনিট অন্তর) সি-১এ শিয়ালদহ-তালতলা-বিধান মার্কেট
-রবীন্দ্র সদন-দ্বিতীয় সেতু-মন্দিরতলা (৩০ মিনিট অন্তর) |
ভূতল পরিবহণ |
বিবাদী বাগ/ধর্মতলা-হাওড়া স্টেশন-বঙ্কিম সেতু-
জিটি রোড-ফোরশোর রোড-কাজিপাড়া-ব্যাতাইতলা |
সিএসটিসি |
শাট্ল ১ রবীন্দ্র সদন-দ্বিতীয় হুগলি সেতু-নবান্নশাট্ল
২ হাওড়া স্টেশন-কাজিপাড়া মোড় |
• এ ছাড়া ৫, ৬, ৭এ, ৮বি, ১০, ১২ডি, এস-১২, এস-২৪, ইএস-৩৭ রুটের কিছু বাস মন্দিরতলা ও কাজিপাড়া মোড় পর্যন্ত যাবে। |
• কাজিপাড়া-ব্যাতাইতলা থেকে ১০টি গাড়ি দিনভর ১২ জন করে সরকারি কর্মী নিয়ে যাতায়াত করবে। |
|
নবান্ন’য় যখন এ হেন তুঙ্গ তৎপরতার ছবি, মহাকরণের আনাচে-কানাচে তখন ছড়িয়ে পড়েছে বিদায়বেলার আবহ। অধিকাংশ দফতরের বাইরে ডাঁই করে ফেলা বড় বড় বস্তাবন্দি ফাইল-নথি। জাভেদ খান, অমিত মিত্রের মতো বিভিন্ন মন্ত্রীর ঘর এ দিন একে একে ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে। খালি করে ফেলা হয়েছে পূর্তসচিব, অর্থসচিবের ঘরও। মহাকরণের বেশির ভাগ ঘর থেকে যাবতীয় আসবাবপত্র নবান্নে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সকাল থেকেই ফাইল-নথি-চেয়ার-টেবিল-আলমারিতে বোঝাই হয়ে নতুন ঠিকানায় রওনা দিয়েছে ট্রাক ও ভ্যানের কনভয়।
মুখ্যমন্ত্রী কবে আবার সপার্ষদ ফিরবেন? এখনই বুঝি দিন গুনতে শুরু করল মহাকরণ।
|
নবরূপে নবান্ন |
কোথায় |
কোন দফতর |
পনেরোতলা |
|
চোদ্দোতলা |
মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়, কনফারেন্স রুম,
ক্যাবিনেট রুম, ক্যাবিনেট সচিবালয়,
মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজি-র অফিস |
তেরোতলা |
অর্থ |
বারোতলা |
অর্থ |
এগারোতলা |
অর্থ |
দশতলা |
তথ্য ও সংস্কৃতি |
ন’তলা |
পূর্ত |
আটতলা |
কর্মিবর্গ, প্রশাসনিক সংস্কার |
সাততলা |
ভূমি ও ভূমিসংস্কার |
ছ’তলা |
স্বরাষ্ট্র |
পাঁচতলা |
স্বরাষ্ট্র |
চারতলা |
মাদ্রাসা-শিক্ষা,
কৃষি, সংখ্যালঘু |
তেতলা |
বিপর্যয় মোকাবিলা,
পুলিশ ডিরেক্টরেট |
দোতলা |
সাক্ষাৎপ্রার্থীর ঘর, ডাক্তার,
প্রেস কর্নার, মুখ্যমন্ত্রীর তহবিল সেল |
একতলা |
পার্কিং |
|
পুরনো খবর: অক্টোবর থেকে আগাপাশতলা সারাই শুরু |
|