লোকসভা ভোটের আগে দিল্লির বঞ্চনার বিরুদ্ধে সুর আরও চড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, বাম সরকারের ঋণের বোঝা সংক্রান্ত সমস্যা মেটানোর জন্য তিনি বহু বার কেন্দ্রকে অনুরোধ করলেও লাভ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলীয় সভা থেকে তৃণমূল নেত্রী বলেন, “চরম হুঁশিয়ারি দিচ্ছি না, কিন্তু কেন্দ্রের কাছে আবেদন করছি, সমস্যা মেটান। রাজ্যের রাজস্বের টাকা নিয়ে যাওয়া বন্ধ করুন। এটা না করলে আমি দিল্লিতে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে বাধ্য হব।” সেই বিক্ষোভে প্রয়োজনে বাংলা, বিহার, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ থেকে ১ কোটি ছেলেমেয়ে নিয়ে যাবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন তিনি। মমতা বলেন, “আমি কোনও প্রোটোকল জানি না। আমি একটাই প্রোটোকল জানি, তা হল জনগণ। সেই জনগণের টাকা কেটে নিলে হাজার বার প্রতিবাদ হবে।”
পঞ্চায়েত ও পুরসভায় বিপুল জয়ের পর নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের সাধারণ পরিষদের বর্ধিত সভায় বক্তৃতার শুরু থেকেই কেন্দ্রকে তুলোধোনা করেন মমতা। সভায় তৃণমূলের সদ্য জয়ী পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদে বা পুরসভার সদস্যদের পাশাপাশি বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যের দলীয় প্রতিনিধিরাও ছিলেন। এ দিনের সমাবেশের গুরুত্ব রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরে নিয়ে যেতে তৎপর ছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সে কারণে মুকুল রায়, ডেরেক ও ব্রায়েন, কে ডি সিংহ, শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারী, সুখেন্দু শেখর রায়-সহ একাধিক নেতাকে নানা রাজ্যে সংগঠন প্রসারের দায়িত্ব দিয়েছেন মমতা।
মমতা এ দিন ফের বাম আমলের ঋণের প্রসঙ্গ তোলেন। এ নিয়ে প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রীও সমালোচনা করেছেন তিনি। সভায় মমতা বলেন, “দমদমে এক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ঋণ পুনর্গঠন করা যায় কিনা, দেখবেন। কিন্তু তা ওঁরা করেছেন কি?” ইন্ডোরের সভামঞ্চ থেকেই তিনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও মুকুল রায়কে বলেন, “মুকুল, তুমি দলের সব সাংসদকে নিয়ে দিল্লি গিয়ে বিক্ষোভ দেখাও। আমরা কি ছাগলের তৃতীয় ছানা, যে সিপিএম ধার করে গিয়েছে, আর আমাদের শোধ করতে হবে?” সভায় নাম না করে দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্বকে কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাজনীতিতে পাত্তা না পেয়ে, বাংলাকে ভাতে মারতে চাইছো!” দেশের অর্থনীতির বেহাল পরিস্থিতি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়েও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন মমতা।
পূর্বতন সরকারের ঋণের বোঝা তো কমেইনি, তার উপর সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের নেতৃত্বাধীন কমিটির নতুন সূচকে (‘মাল্টি ডাইমেনশনাল ইনডেক্স) ব্যাপক চটেছেন মমতা। সরকারে আসার পরই পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ অর্থ সাহায্যের দাবি করেন মমতা। এই নতুন সূচকে পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষাকৃত কম অনুন্নত রাজ্যের তালিকায় থাকায় কেন্দ্রীয় সাহায্যের বরাদ্দ কিছু কমবে। ইতিমধ্যেই মমতা বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, “অন্য রাজ্যকে টাকা দেওয়া ভাল। বিহার, ওড়িশা, কেরল কেন্দ্রের সাহায্য পাওয়ায় আমি খুশি। কিন্তু বাংলা অখুশি।” দলীয় সূত্রের খবর, নয়া সূচকের বিরুদ্ধে দিল্লিতে প্রতিবাদ জানাতে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডেরেক ও’ব্রায়েনকে নির্দেশ দেন মমতা। তৃণমূল সাংসদদের অক্টোবরের ৭ ও ৮ তারিখ দিল্লিতে থাকতে বলা হয়েছে।
এ দিনের সভায় সিপিএমের টাকার সূত্র এবং তা নিয়ে কেন্দ্র তদন্ত না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মমতা। তিনি বলেন, “২০১১-১২ আর্থিক বছরে সিপিএম অজ্ঞাত সূত্র থেকে ২৮০.৫৯ কোটি টাকা তুলেছে। কী করে, কোথা থেকে টাকা আসছে কেন্দ্র দেখবে না!” সিপিএমের সমালোচনা করে মমতা বলেন, “তোমাদের তো জোট রয়েছে। দিল্লিতে কংগ্রেসের সঙ্গে। এখানে গ্রামেগঞ্জে বিজেপির সঙ্গে জোট করছ সিপিএম।”
আগামী লোকসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তার আগে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপর চাপ সৃষ্টি করতেই মমতা কড়া বার্তা দিয়েছেন বলে তৃণমূল নেতাদের একাংশের অভিমত। দলনেত্রীর মতোই এ দিন দিল্লির বিরোধিতায় সরব হন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মুকুলবাবু-সহ বিভিন্ন নেতা। ইউপিএ সরকারের সমালোচনা করে সুদীপবাবু বলেন, “রাজ্যের উপর আর্থিক বোঝা কমানোর ব্যাপারে, রাজ্যের বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য আমাদের দাবি যাঁরা কানে তুলছেন না, লোকসভা ভোটের পর তাঁরাই সমর্থন করার জন্য মহাকরণে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ে ধরবেন।” সুব্রতবাবু বলেন, “আগামী দিনে দিল্লিতে কে সরকার গড়বে, তা কংগ্রেস বা বিজেপি ঠিক করবে না। ঠিক করবেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।” |