ডেভিড বনাম গোলিয়াথের যুদ্ধে ‘ডেভিড’ হয়েও জিততে জানে ইস্টবেঙ্গলকথাটা মানেন আসগর সরাফি। জানেন, উত্তর কোরিয়ার মিরং। মঙ্গলবার রোজারিও আর ইসাম জেমাও কি সেটা জেনে যাবেন?
১৯৭০-এ আইএফএ শিল্ড ফাইনালে খেলা সরাফি ইরানের পাজ ক্লাবের জার্সি গায়ে তাঁর জমানায় এশিয়ার সেরা লেফট উইঙ্গার। তিয়াত্তরের ডিসিএম ফাইনাল খেলা ডক রো গ্যাং-এর মিরং আবার বিশ্বকাপেও খেলেছেন। এই দু’জনকে বোতলবন্দি করে দু’বারই ইস্টবেঙ্গলকে জয় পেতে যিনি সাহায্য করেছেন, ময়দানের সেই ‘অতিমানব ডিফেন্ডার’ সুধীর কর্মকার বলছেন, “জেমাও মঙ্গলবার জেনে যেতে পারে অসম লড়াইয়েও ইস্টবেঙ্গল কী জিনিস। রক্ষণ আঁটোসাঁটো করে মোগাদের দেখিয়ে দিতে হবে আমরাও ফুটবলটা জানি।”
সুধীরের কথাটাই প্রায় শোনা গেল অ্যালভিটো ডি’কুনহার গলায়। বিকেলে অনুশীলনে যাওয়ার ফাঁকে অ্যালভিটো কুয়েত থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, “ভারতীয়রা যে ফুটবল খেলতে পারে মাঠে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করবই।” মধ্যপ্রাচ্যের দলের বিরুদ্ধে দেশের জার্সি গায়ে গোল রয়েছে অ্যালভিটোর। ফোন রাখার আগে তাঁর ছোট্ট সংযোজন, “মনে রাখবেন আমরা কিন্তু জর্ডনের আল উইদাতকে হারিয়েছিলাম এই এএফসি কাপেই। কাল কেউ গোল করে জেতালেই আমি তাঁকে বুট আর পারফিউম উপহার দেব।” |
অ্যালভিটোর আবেগপূর্ণ কথাবার্তা বলে ফেলাটা স্বাভাবিক। এত বড় সন্ধিক্ষণে কখনও এর আগে পড়েনি ইস্টবেঙ্গল। শুধু ইস্টবেঙ্গল কেন, ভারতও তো জানে না এএফসি ফাইনাল কী বস্তু! যে সিঁড়ির প্রথম ধাপটা পেরোনোর পরীক্ষা মঙ্গলবার। পরীক্ষা, কুয়েত এসসি-কে নক আউট করার।
এত দিন পর্যন্ত এএফসি কাপে সেরা পারফর্মার ছিলেন আর্মান্দো কোলাসো। তাঁর ডেম্পো শেষ চারে উঠেছিল, কিন্তু কাতারের আল সাদ শেষ চারের কাঁটাতার তাদের পেরোতে দেয়নি। গোয়া থেকে যে আর্মান্দো এই প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন, শুনলে মনে হবে ইস্টবেঙ্গল নয়, যেন ডেম্পোই নামছে কুয়েত এসসি-র বিরুদ্ধে! ক্লাবের পৃথিবীতে তিনি আটকে নেই, আর্মান্দো যেন ঢুকে পড়েছেন বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে। যেখানে ক্লাবের আগে দেশ। ইস্টবেঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করছেন, ফালোপাকে টিপসও দিচ্ছেন। বলছেন, “ওদের রবার্ট ওভারল্যাপে গিয়ে নামতে সময় নেয়। শারীরিক ভাবে শক্তপোক্ত পশ্চিম এশিয়ার দলগুলো কিন্তু এই সুযোগ ছাড়বে না। ইস্টবেঙ্গল জিতলে ভারতীয় ফুটবলে ইতিহাস হবে। আমি পারিনি। ইস্টবেঙ্গল যেন পারে।”
পারবেন ফালোপা?
আত্মবিশ্বাসী ইস্টবেঙ্গল কোচ কিন্তু কুয়েত থেকে বললেন, “কাজটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।” কাজে এতটুকু ঢিলেমি নেই, এ দিন অনুশীলন দেখতে আসা ভারতীয়দের থেকে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে তথ্য নিয়েছেন। কুয়েতে উপস্থিত ভারতীয় সাংবাদিকদের সাহায্য নিয়েছেন। আর ফালোপার ‘মধ্যপ্রাচ্যের রেফারি ওদের টেনে খেলায়’ হুঙ্কারের প্রতিফলন কি না কে জানে, এএফসি ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে রাখেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনও রেফারিকে। দায়িত্বে চিনা রেফারি, যা নাকি ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কাছে আশির্বাদ! নানা ভোগান্তির মাঝে। পানীয় জলকষ্টের পর যোগ হল যাতায়াত-ভোগান্তি। সকালে আসা মেহতাব-অর্ণবদের জন্য ন্যূনতম গাড়িটাও পাঠানো হল না! আসতে হল ট্যাক্সিতে।
মাঠের বাইরের প্রশ্নপত্র যদি এমন কঠিন হয়, তা হলে মাঠের ভেতরেটা আরও কড়া। মারিন ইয়োনের ছেলেদের উড়িয়ে ফাইনালে উঠতে হলে, মঙ্গলবার ইস্টবেঙ্গলের চাই নিদেনপক্ষে ড্র। তার পর ঘরের মাঠে অবশ্যই জয়। ফালোপার মাথাতেও প্রায় এক স্ট্র্যাটেজি ঘুরছে। বলছিলেন, “রক্ষণকে ঠিকঠাক করে ভাল ফুটবল খেলব। ট্র্যাভেলের ধকল রয়েছে। সেমিফাইনালের প্রস্তুতির জন্য বেশি সময়ও পাইনি। কিন্তু আমরা ছাড়ছি না।” অধিনায়ক মেহতাবও বললেন, “আমরা আন্ডারডগ, জানি। কিন্তু কাল আমাদের সেরা পারফরম্যান্সটা বেরোবে।”
মেহতাব বলছেন বটে, কিন্তু কুয়েত এফসি আবার দু’বারের এএফসি জয়ী। তিউনিসিয়ান ফরোয়ার্ড ইসাম জেমা-ই হোক বা ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড রোজেরিও পায়ে বল পড়লে, বিপক্ষের জাল নড়ে! দু’জনের মধ্যে জেমা আবার ফরাসি লিগে একশোর উপর ম্যাচ খেলে বসে আছেন! কতটা ভয়ঙ্কর এই ব্রাজিল-তিউনিশিয়া জুটি? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মলদ্বীপের আলি আশফাককে মনে আছে? সাফে যিনি মেহতাবদের কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন? সেই আশফাকের নিউ র্যাডিয়্যান্ট স্রেফ উড়ে গিয়েছে এই বিধ্বংসী জুটির কাছে।
এএফসি-র কোয়ার্টার ফাইনালের দু’টো পর্ব মিলিয়ে স্কোর ১২-২! রোজেরিও-জেমার হুঙ্কারে ছিন্নভিন্ন আশফাক!
শুনে মনোহরপুকুরের বাড়িতে বসে চোটগ্রস্ত সুয়োকার স্বগতোক্তি, “মোগারা নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে।”
এই ‘কিছু একটা’ করতেই ফালোপার মগজে দুটো ছক। এক) কুয়েতের মাঠে রক্ষণ জমাট করে ৪-২-৩-১ ছকে দল নামিয়ে দাও। সে ক্ষেত্রে প্রথম দলে চিডিকে দেখতে না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সামনে শুধু মোগা। দুই) ৪-৪-১-১ ছকে পাল্টা কুয়েতকে চেপে ধরার জন্য আক্রমণে মোগার কিছুটা পিছন থেকে চিডিকে অপারেট করানো। মাঝমাঠে ডান দিকে জোয়াকিম আব্রাঞ্চেজ, বাঁ দিকে সৌমিক। নওবা-উগা-অর্ণব-রবার্টের ব্যাক ফোরের আগে দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মেহতাব এবং খাবরা। টিম সূত্রে খবর, দ্বিতীয় ছকই মনে ধরেছে কোচের। মোগা আবার আগাম গর্জন করলেন, “ক্লাব নয়। খেলব ভারতীয় ফুটবলের জন্য।”
কুড়ি বছর আগে এএফসি কাপ উইনার্স কাপে ইরাকের আল জাওড়া ক্লাবকে ৬-১ হারিয়েছিল লাল-হলুদ। কার্লটন চ্যাপম্যান একাই করেছিলেন তিন গোল। আর এক গোলদাতা কুমারেশ ভাওয়াল বলছেন, “কাজটা কঠিন। তবে ইস্টবেঙ্গল বলেই আশায় বুক বাঁধছি।”
পঁয়ষট্টি বছর আগে এ রকমই ডেভিড বনাম গোলিয়াথের যুদ্ধে বাজিমাত করেছিলেন লাল-হলুদেরই এক ভারতীয় সৈনিক। ’৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিক থেকে দেশে ফেরার পথে আয়াখস আমস্টারডামকে ১-০ হারিয়েছিল ভারত। গোলদাতার নামআমেদ খান।
মঙ্গলবার রাতে টিভির সামনে লক্ষ-লক্ষ চোখ কুয়েতের মাঠে খুঁজবে কোনও ‘আমেদ’-কে, কোনও ‘চ্যাপম্যান’-কে। ক্লাবের তিরানব্বই বছরের ইতিহাসে ট্রফি কম নেই। আসিয়ান ঢুকেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এএফসি কাপ ঢোকেনি।
এএফসি-তে এ বার মশালের রং লাল-হলুদ কি না, বোঝা যাবে আজ।
|
লাল-হলুদের ‘গোলিয়াথ’ বধ |
|
ইস্টবেঙ্গল ৩ : বেক তেরো সাসানা ১ (২০০৩ আসিয়ান কাপ ফাইনাল)
ইস্টবেঙ্গল ৩ : পিয়ং ইয়ং ১ (১৯৭৩ সালে আইএফ এ শিল্ড ফাইনাল)
ইস্টবেঙ্গল ৩ : ত্রেঙ্গানু ০ (১৯৭৩ সালে আইএফ এ শিল্ড গ্রুপ ম্যাচে)
ইস্টবেঙ্গল ২ : সেলাঙ্গর ০ (১৯৭২ সালে আইএফএ শিল্ড সেমিফাইনাল)
ইস্টবেঙ্গল ১ : পাজ ক্লাব ০ (১৯৭০ সালে আইএফএ শিল্ড ফাইনাল) |
|
আজ টিভিতে |
এএফসি কাপ সেমিফাইনালের লড়াইয়ে মুখোমুখি:
কুয়েত এসসি ও ইস্টবেঙ্গল
(ইএসপিএন, রাত ১০টা) |
|
ইস্টবেঙ্গল জিতলে ভারতীয় ফুটবলে ইতিহাস হবে। আমি পারিনি। ইস্টবেঙ্গল যেন পারে।
আর্মান্দো কোলাসো |
|