|
|
|
|
পাশে সনিয়া, মাঝপথে হাল ছাড়তে নারাজ মনমোহন |
জয়ন্ত ঘোষাল • নিউ ইয়র্ক
|
নিউ ইয়র্ক প্যালেস হোটেলে গত কাল বৈঠক করতে এসে ঘরোয়া আলোচনায় নওয়াজ শরিফ প্রথমেই মনমোহন সিংহকে বলেছিলেন, তিনি লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। দেহাতি মহিলার মতো কোনও শব্দই তিনি ব্যবহার করেননি। কিন্তু মনমোহন তাঁকে থামিয়ে দেন। মনমোহন বলেন, তাঁর এ বিষয়ে কিছুই জানার দরকার নেই। প্রায় দশ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে রয়েছেন। যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, সে সময় তিনি সংবেদনশীল ছিলেন। এখন দশ বছর প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে তাঁর চামড়া গন্ডারের মতো মোটা হয়ে গিয়েছে। এ সবে যে তিনি আর কিছু মনে করেন না, মনমোহন তা নিজেই স্বীকার করে নেন।
এ যেন ‘তোমরা যা বলো, তাই বলো, আমার লাগে না মনে’। আর তা পাকস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, রাহুল গাঁধী বা নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য!
প্রায় পাঁচ দিন দেশের বাইরে কাটালেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে রাহুল গাঁধীর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দিল্লির রাজনীতিতে তুলকালাম শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু, মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার ভাই সঞ্জীব অহলুওয়ালিয়ার মতো ঘনিষ্ঠরা মত দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু মনমোহন
কোনও ভাবেই ইস্তফা দেওয়ার কথা ভাবছেন না। তিনি তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করতে চাইছেন।
কোনও প্রধানমন্ত্রীই তাঁর শাসনকাল অসমাপ্ত রেখে বিদায় নিতে চান না। ক্ষমতার নিজস্ব আবহ, সাত নম্বর রেস কোর্স রোডের মোহ যে কোনও রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অটলবিহারী বাজপেয়ী এনডিএ-জমানায় ছ’মাস আগে ভোট করতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। লালকৃষ্ণ আডবাণী আগ্রহী ছিলেন। তাতে কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসেনি। গুলজারিলাল নন্দা দু’বার অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এক বার জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর, এক বার লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর। দু’বারই অল্প দিনের জন্য। কিন্তু মনমোহনের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। তিনি রাহুল গাঁধীর জন্য ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে রাজি আছেন। তিনি সনিয়া গাঁধীর অনুগত। সনিয়াই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করেছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় বা পি চিদম্বরমকে না করে। এখনও সনিয়ার আস্থা রয়েছে তাঁর উপরে। ছেলে রাহুলের মন্তব্যে তৈরি হওয়া বিতর্কের মধ্যেও কংগ্রেস সভানেত্রী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন, মনমোহনকে শ্রদ্ধা করেন তিনি। বস্তুত আজও বিজেপি-র কটাক্ষ-বিদ্রুপের জোরদার জবাব দিতে সনিয়া ঘোষণা করেছেন, “গোটা দল প্রধানমন্ত্রীর পাশে রয়েছে।” এ অবস্থায় মাঝপথে হাল ছাড়ার কথা ভাবতে রাজি নন মনোমহন। তিনি বরং ভাবছেন, নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব এমনকী, নরসিংহ রাওয়ের যেমন যুগ ছিল, তেমনই মনমোহন সিংহের শাসনকালও ইতিহাসে থেকে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের তরফে বলা হচ্ছে, মনমোহন সিংহ এই সফরে যা কাজ করার সবই করেছেন। একদম বাস্তবের মাটিতে পা রেখে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। সামনে লোকসভা নির্বাচন। তাই এর পরে নয়াদিল্লির রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পাবেন না। কিন্তু মনমোহন-নওয়াজের বৈঠকের ভিত্তিতে বিদেশ মন্ত্রকের আমলা ও কূটনীতিকদের পর্যায়ে কাজ এগোবে। দু’দেশের ডিরেক্টর জেনারেল (মিলিটারি অপারেশন) আলোচনায় বসবেন।
গত কালের বৈঠকের শেষে হাডসন নদীর তিরে নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক কর্তা বলছিলেন, দর কষাকষি ও কথা বলার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দর কষাকষি না হলেও কথা বলা জরুরি। কিন্তু তা করতে গিয়ে একেবারে শান্তির পায়রা ওড়ানোর পথেও হাঁটেননি মনমোহন। নওয়াজ চেয়েছিলেন, দু’দেশের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব ও সেনা কম্যান্ডারদের নিয়ে একটি যৌথ তদন্ত কমিটি হোক। যারা নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। প্রধানমন্ত্রী রাজি হননি। বিদেশ মন্ত্রক ও সেনাকেও মেলাতে চাননি তিনি।
মনমোহন জানেন, এই পরিস্থিতিতে ক্ষোভ দেখিয়ে চলে যাওয়া যায় না। মাঝপথে ইস্তফা দিলে ইউপিএ-সরকারের জন্যই আরও সঙ্কট তৈরি হবে। কংগ্রেস বিপাকে পড়বে। নরেন্দ্র মোদীরই সুবিধা হয়ে যেতে পারে। ইতিহাসে থেকে যাবে, মনমোহন নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার বদলে তিনি এখন আরও আগ্রাসী মনোভাব নিতে চাইছেন। গত ক’দিন তিনি যেটা উচিত মনে করেছেন, সেটাই করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের বদলে কিছু ক্ষেত্রে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বারাক ওবামার সঙ্গে বৈঠকের আগে আলোচ্যসূচির খসড়ায় পাকিস্তানের প্রসঙ্গ ছিলই না। নিজেই সেটা যোগ করেন। ওবামাকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, পরমাণু চুক্তির রূপায়ণের দায়বদ্ধতা বিল পাশ করানো এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি তিনি করে ফেলেছেন। ঘরোয়া রাজনীতির কারণে এ বারের সফরে আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের থেকেও পাকিস্তানের বিষয়টিই বড় হয়ে উঠেছে। ভোটের কথা ভেবে সেখানেও মনমোহন পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারতে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কঠোর মনোভাব নিয়েছেন। কাজেই শুধু প্রশাসক নন, রাজনৈতিক নেতার ভূমিকাও পালন করেছেন তিনি। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই এগিয়েছেন তিনি।
দেশে ফিরেও সেটাই করতে চান প্রধানমন্ত্রী। অর্ডিন্যান্স নিয়ে এক দিকে যেমন রাহুলের সঙ্গে আলোচনা করবেন, তেমনই বৈঠক করবেন সনিয়ার সঙ্গেও। সেখানে বোঝাপড়া হবে। রাহুলের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের আবহ তৈরি হওয়ায় তিনি যে ব্যথিত, হতাশ ও ক্ষুব্ধ, তা তিনি জানাবেন। ইউপিএ জমানার এক দশকে জনমনে যেটুকু প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা তৈরি হয়েছে, কংগ্রেস যেন তার দায় একা মনমোহনের ঘাড়ে চাপানোর কৌশল না নেয়, তার জন্য সরব হবেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু প্রকাশ্যে কিছুই বলবেন না। আবার ইস্তফাও দেবেন না। |
পুরনো খবর: মনমোহন, নওয়াজের পর এ বার আলোচনা সেনা স্তরে |
|
|
|
|
|