ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। তবে ভিন্ন আবহে।
১৫ বছর আগে এই হোটেল নিউ ইয়র্ক প্যালেসে বসে লাহৌর বাসযাত্রার নীল-নকশা তৈরি করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী ও নওয়াজ শরিফ। সেই হোটেল। সেই নওয়াজ। কিন্তু এ বার সম্প্রীতি বাড়ানোর প্রসঙ্গ নয়, পাকিস্তানের তরফে ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন নিয়ে মনমোহন সিংহের জোরালো অভিযোগের মুখে পড়তে হল পাক প্রধানমন্ত্রীকে। ঘণ্টাখানেকের বৈঠকে স্থির হল, নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধে শীঘ্রই বৈঠক হবে সামরিক কর্তাদের মধ্যে। আলোচনায় বসবেন দু’দেশে ডিরেক্টর জেনারেল (মিলিটারি অপারেশনস)। সীমান্তপারের সন্ত্রাস, মুম্বই হামলার চক্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে চরম টালবাহানা নিয়েও শরিফকে চাপের মুখে পড়তে হয় এ দিন। তাঁরা নিজেরাও সন্ত্রাসের শিকার শরিফ এই প্রসঙ্গ তুললেও আশ্বাস দিয়েছেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে মুম্বই হামলার চক্রীদের বিরুদ্ধে।
ভারত কী চোখে দেখছে এই বৈঠককে, কিংবা শরিফের ওই আশ্বাসকে? বৈঠকের পরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন কোনও গালভরা সাফল্যর কথা না শুনিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন মনমোহনী নীতির কথা। তা হল, বন্ধু বেছে নেওয়া যায়, কিন্তু প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে সমস্যা তৈরি হলে তা এড়িয়ে থাকা যায় না। মোকাবিলা করতে হয়। সেটাই করা হয়েছে এ দিন। এখন যখন নিয়ন্ত্রণরেখায় সন্ত্রাস মাথা চাড়া দিয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দু’দেশের মধ্যে শীর্ষ স্তরে একটা যোগাযোগ যে হল, আজকের বৈঠকের ফল বলতে সেটাই। বাস্তবে কী হবে, তা বোঝা যাবে আগামী কয়েক মাসে।
পাকিস্তানে পালাবদলের পালা সমাপন করে দেশত্যাগী শরিফ আবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফিরেছেন সগৌরবে, পাঁচ মাস হতে চলল। অন্য দিকে মনমোহন তাঁর শাসনকালের প্রায় ১০ বছর অতিবাহিত করে নির্বাচনী অগ্নিপরীক্ষার সামনে। নওয়াজ এই দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মনমোহনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে টেলিফোনে। কিন্তু দুই পঞ্জাবি নেতার আজ প্রথম সাক্ষাৎ। সকাল দশটায় শুরু হলেও প্রাতরাশ বৈঠক এটি ছিল না। মনমোহন সিংহের পক্ষ থেকে চা-কফির আয়োজন ছিল। ছিল বিস্কুট ও কুকিও। তবে ভারত-পাক সংঘাতের আবহ ঘুচিয়ে এই বৈঠক যে রোমান্টিকতা তৈরি করবে এমন প্রত্যাশা ছিল না। তা হয়ওনি।
বরং পাক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, মনমোহন যে ভাবে বারাক ওবামার কাছে পাকিস্তান সম্পর্কে নালিশ করেছেন, তাতে খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছেন শরিফ। তাঁর মতে, দুই দেশ নিজেরাই আলোচনা করে সমস্যা মেটানোর পথ খুঁজে বার করুক। এ জন্য আমেরিকাকে ডাকা অনর্থক। শীর্ষ বৈঠকে নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন বন্ধের দাবির মুখে শরিফ টেনেছেন চিরাচরিত সিয়াচেন ও স্যর ক্রিক প্রসঙ্গ। তুলেছেন বালুচিস্তানে অশান্তির পিছনের ভারতের হাত থাকার অভিযোগও। এর মধ্যেও মুখোমুখি আলোচনায় বসে দু’জনেই কিন্তু পরস্পরের দেশে সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। সন্ত্রাস দমনের প্রশ্নে দু’দেশই একটি মেকানিজম গড়ার প্রশ্নে রাজি হয়েছে এ দিন। যে মেকানিজমে দু’পক্ষের বিদেশ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রতিনিধিরা থাকবেন। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, এই মেকানিজমের বিষয়টিও নতুন কিছু নয়। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হাভানার বৈঠকে মনমোহন এবং তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ নতুন আস্থাবর্ধক পদক্ষেপ হিসাবে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মেকানিজম গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে বেশ কয়েকটি বৈঠক ছাড়া বিশেষ কিছু প্রসব করে উঠতে পারেনি ওই মেকানিজম।
বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফর করেছিলেন কলম্বোয়। সেটি ছিল সার্ক সম্মেলন। তখন তাজ সমুদ্র হোটেলে নওয়াজের সঙ্গে প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল তাঁর। সেই বৈঠকের পর দুই নেতা পৃথক পৃথক সাংবাদিক সম্মেলন করেন একই হোটেলে। প্রথমে বাজপেয়ী সাংবাদিক বৈঠক করে দু’দেশের মধ্যে শান্তির বার্তা দেন। তার পর ভারতীয় পতাকা সরিয়ে নিয়ে মঞ্চে রাখা হয় পাক-পতাকা। কম্যান্ডো পরিবেষ্টিত হয়ে আসেন নওয়াজ। এসেই আক্রমণ করেন ভারতকে। বলেন, বাজপেয়ীর সঙ্গে আলোচনার নিট ফল শূন্য! তিনি অভিযোগ করেন, কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা অনবরত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। ওই সাংবাদিক বৈঠকে এই প্রতিবেদকের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিসার অশোক টন্ডন। তিনি বিস্মিত কণ্ঠে বলেন, বিষয়টি সত্যিই খুব মজাদার! কেননা বৈঠকে নওয়াজ শান্তির পায়রা ওড়ালেন, আর বাইরে এসে সাংবাদিকদের সামনে বলছেন কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা।
পাকিস্তানের কূটনীতিকরা অবশ্য সে সময় ভারতীয় কূটনীতিকদের বলেন, এটি ঘরোয়া রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন। বৈঠকের পর ভারতের উপর খড়গহস্ত না হলে পাকিস্তানে ফিরে মোল্লাতন্ত্র, পাক সেনা এবং আইএসআই-এর তোপের মুখে পড়বেন নওয়াজের নেতৃত্ব। এ বিষয়টি নিয়ে নয়াদিল্লির কূটনৈতিক শিবির যেন কিছু মনে না করেন! আজ মনমোহনের সামনেও সেই ঘরোয়া রাজনৈতিক সঙ্কট। তিনি নিজে বারবার পাকিস্তান সফরে যেতে চেয়েছেন। ভারত-পাক সুসম্পর্কের জন্য উচ্চকণ্ঠে সওয়াল করেছেন।
কিন্তু মুম্বই হামলার ঘটনা গোটা আবহটাকেই বদলে দিয়েছে। অন্য দিকে অর্ডিন্যান্স নিয়ে রাহুলের আক্রমণের মুখে মনমোহনের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব একটি বড় চ্যালেঞ্জের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে ভোট। বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নেতা নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তেড়েফুঁড়ে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন।
নওয়াজের সফরসঙ্গী হামিদ মির একটি ভারতীয় চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এক জন দেহাতি অওরত যে ভাবে কান্নাকাটি করে, মনমোহনও ঠিক সে ভাবে কাঁদছেন আমেরিকার কাছে। স্বাভাবিক ভাবেই এখনকার এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে আজকের বৈঠকে সন্ত্রাসের প্রশ্নে কড়া কথা বলতে হয়েছে। চাপ তৈরি করতে হয়েছে ইসলামাবাদের উপর।
তবে এই চাপটা শুধুই শরিফ সরকারের উপরে কেন্দ্রীভূত রাখছে না ভারত। মনম্যহন-শরিফ বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পরেই বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ এ দিন এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ এনেছেন, শরিফ সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতির চেষ্টা শুরু করতেই আইএসআই এবং পাক সেনা তা ভেস্তে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ভারতীয় কূটনৈতিক কর্তারা তবু মনে করছেন, দু’দেশের মধ্যে শীর্ষ স্তরে আলোচনায় বসাটাই একটা বড় কূটনৈতিক সাফল্য। দু’টি পরস্পর বিবদমান পরমাণ্ু শক্তিধর দেশের নেতা যদি এক মঞ্চে এসে করমর্দনও করেন, সেটিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই করমর্দন কতটা উষ্ণ অথবা শীতল সেই প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ তখন আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। |