মন্তব্য বিতর্কে ফায়দা তুলতে আসরে মোদী
নেহাতই সাধারণ দু’টি শব্দ দেহাতি অওরত। গ্রাম্য মহিলা। আর তাই নিয়েই দিনভর সরগরম হয়ে রইল নিউ ইয়র্ক থেকে নয়াদিল্লি।
মনমোহন সিংহ সম্পর্কে নওয়াজ শরিফ এই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন কি না, তা নিয়ে যখন নানা মহলে তুমুল তরজা চলছে, তখনই আসরে নেমে পড়লেন নরেন্দ্র মোদী। এবং খবরের সত্যাসত্য যাচাইয়ের পথে না হেঁটে বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে ঘরোয়া রাজনীতিতে ফায়দা তুলতে সক্রিয় হলেন তিনি। আজ দিল্লিতে এক জনসভায় এই মন্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে এক দিকে মোদী পাক প্রধানমন্ত্রীকে হুঁশিয়ার করে বললেন, এই কথা বলার সাহস হয় কী ভাবে! মোদীর এই মন্তব্য শুনে কেউ যদি ভেবে থাকেন, বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী আসলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা হলে তাঁকে বাজি হারতে হবে। কারণ, ওই সভাতেই মোদীর পরবর্তী মন্তব্য, ‘কংগ্রেসের সহ-সভাপতিই যখন প্রধানমন্ত্রীর পাগড়ি খুলে নিয়েছেন, তখন নওয়াজ আর কে’! অর্থাৎ, এ বারে তাঁর ব্যঙ্গের নিশানায় মনমোহনই!
বিতর্কের শুরু পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মিরের এক সাক্ষাৎকার থেকে। ভারতেরই একটি সংবাদ চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হামিদ বলেন, শনিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠকের সময় এক একান্ত আলাপচারিতার ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন মনমোহন সিংহের উদ্দেশে। নওয়াজ নাকি বলেছেন, এক জন গ্রাম্য মহিলা যেমন কান্নাকাটি করেন, আমেরিকায় এসে মনমোহন ঠিক সে ভাবেই কাঁদছেন! পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন বারাক ওবামার কাছে!
দুই প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকের আগে নওয়াজ শরিফ ও মনমোহন সিংহ।
হোটেল নিউ ইয়র্ক প্যালেসে রবিবার। ছবি: এএফপি
ভারত-পাক প্রধানমন্ত্রী স্তরে বৈঠক শুরুর প্রাক্কালে করা হামিদ মিরের এই মন্তব্য নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। আর এই সুযোগ ছাড়তে চাননি নরেন্দ্র মোদী। আজ দিল্লির জনসভায় এই মন্তব্যটিকে পুঁজি করে এক ঢিলে তিন পাখি মারার চেষ্টা করেন তিনি। প্রথমে নওয়াজ শরিফকে এক হাত নিয়ে বলেন, “পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এত সাহস হয় কোথা থেকে? প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এই মন্তব্য দেশ সহ্য করবে না।” পাক প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর এই হুঁশিয়ারি শুনে স্বাভাবিক ভাবেই হাততালিতে ফেটে পড়ে জনতা। কিন্তু মোদীর উদ্দেশ্য তো মনমোহনের সহমর্মী হওয়া নয়। বরং সুকৌশলে মনমোহন সিংহের পাশাপাশি রাহুল গাঁধীকেও এক হাত নেওয়াই লক্ষ্য তাঁর। তাই সভায় মোদীর মন্তব্য, “এক অর্ডিন্যান্স নিয়ে বিদেশে সফররত প্রধানমন্ত্রীকে যখন ‘ফালতু’ বলে তাঁর পাগড়ি খুলে দিতে পারেন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি, তখন নওয়াজ আর কে?” মোদী যখন জনসভায় ওই মন্তব্য করছেন, তখনও নিউ ইয়র্কে মনমোহন-নওয়াজ শীর্ষ বৈঠক শুরু হয়নি। সেটা মাথায় রেখেই মোদীর মন্তব্য, “এর পরে মনমোহন সিংহ কি পারবেন শরিফের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে? তিনি তো কথা বলতেই ভুলে গিয়েছেন!”
মোদী যে শুধু কংগ্রেসের নেতাদেরই নিশানা করেছেন, তা নয়। ঠারেঠোরে নিশানা করেছেন, ভারতের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সাংবাদিককেও। মোদী অবশ্য ওই সাংবাদিকের নাম নেননি। কিন্তু এ কথা বলতেও ভোলেননি, “আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করার সময় যে সাংবাদিক সন্দেশ খাচ্ছিলেন, তাঁর উচিত ছিল, সেই সন্দেশ ছেড়ে তখনই সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া!”
মনমোহন-নওয়াজ বৈঠকের আগে দুই দেশের দুই সাংবাদিক গোটা বিষয়টিতে জড়িয়ে যাওয়ায় বিষয়টি অন্য মাত্রা পায়। কারণ, মোদী গোটা বিষয়টি উস্কে দেওয়ায় শুরু হয় নতুন বাক্যুদ্ধ। হামিদ মির পাকিস্তানের জিও টিভির কর্ণধার। কাতারের দোহায় ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন তিনি। নওয়াজ তাঁর প্রাতরাশে যে ক’জন সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তার মধ্যে হামিদ মিরের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন বরখা দত্ত-ও। মনে করা হচ্ছে, বরখাকেই নিশানা করেছেন মোদী। যার ‘জবাব’ দিতে গিয়ে টুইটারে মোদীর উদ্দেশে বরখা বলেন, তাঁর উপস্থিতিতে মনমোহনের প্রতি কোনও অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। একই সঙ্গে বিতর্কের জন্য হামিদের উপরেই দায় চাপিয়ে দিয়েছেন বরখা। বরখা নিজেও একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নওয়াজের। সেখানে মনমোহনকে ‘একজন ভাল মানুষ’ বলেই অভিহিত করেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী।
পাকিস্তানের তরফেও সরকারি ভাবে কোনও রকম কটূ মন্তব্যের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। আজ সকালে নওয়াজ শরিফের নির্দেশে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে ফোন করেন পাক বিদেশসচিব জলিল জিলানি। তিনি মেননকে বলেন, মনমোহন সম্পর্কে কোনও রকম অসম্মানসূচক মন্তব্য করেননি পাক প্রধানমন্ত্রী।
দেহাতি অওরত
বরখা দত্ত
সাংবাদিক, এনডিটিভি
হামিদ মির
সাংবাদিক, জিও টিভি
মোদীর বিস্ফোরণ
প্রাতরাশ বৈঠকে ঠিক কী হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা দিয়ে বরখা পরে টুইটারে দাবি করেন, ‘অফ-রেকর্ড’ নওয়াজ মনমোহন-ওবামা বৈঠক নিয়ে তাঁর অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। বরখার দাবি, ওই বৈঠকের সূত্র ধরে নওয়াজ বলেছিলেন, ভারতের কোনও অসন্তোষ থাকলে তা পাকিস্তানকে সরাসরি বলা উচিত। আর সেখানেই নওয়াজ একটি উপমা টেনে একটি গল্প বলেন। নওয়াজের সেই গল্পে কোনও গ্রামে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া রয়েছে। তার মধ্যে একজন আবার মহিলা। সেই গল্পের সারবস্তু হল, এ ধরনের কোনও বিবাদ হলে দু’জনের মধ্যেই তা মিটিয়ে নেওয়া উচিত। তৃতীয় পক্ষকে মধ্যস্থতা করার জন্য ডাকার কোনও প্রয়োজন নেই। বরখা বলেন, “হামিদ মির যখন অন্য টেলিভিশনে এ কথা বলছেন, শুনে আমি স্তম্ভিত। সাধারণত ‘অফ রেকর্ড’ আলোচনা নিয়ে রিপোর্টিং করা হয় না। তবে এটি যখন বাইরে এসেছে, তাই আমার অবস্থান জানালাম।”
হামিদ মির আবার টুইট করে পাল্টা দাবি করেন, “নওয়াজের সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে বরখা কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। পরে ক্যামেরা নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি সর্বক্ষণ ওখানে ছিলেন না।” কিন্তু হামিদের এই দাবির সঙ্গে একমত নন পাকিস্তান থেকে নওয়াজের সফরসঙ্গী হয়ে আসা অন্য সাংবাদিকরাই। তাঁরাও এখন দুষছেন হামিদকে। তাঁদের মতে, হামিদ আদৌ নওয়াজের সফরসঙ্গী নন। পাকিস্তানের ‘আজ টিভি’র সম্পাদক আফসা আলম নিউ ইয়র্ক প্যালেস হোটেলের আড্ডায় প্রকাশ্যেই বললেন, “শরিফের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠকে আমরাও উপস্থিত ছিলাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করেননি।” চার দিক থেকে এত বিবাদের পর হামিদ জানান, “মনমোহনের প্রতি নওয়াজ কোনও অপমানসূচক মন্তব্য করেননি।”
নিউ ইয়র্কে হাজির পাক সাংবাদিকদের একটা অংশের আবার বক্তব্য, হামিদ মির আইএসআইয়ের ঘনিষ্ঠ। পাকিস্তানের এই গুপ্তচর সংস্থাটি আগাগোড়াই নওয়াজ-মনমোহন বৈঠকের বিরোধী। এবং সে কারণেই বৈঠক শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে হামিদ মির সুকৌশলে ওই মন্তব্যটি ছড়িয়েছেন। কিন্তু মনমোহন বরাবরই চান, আলোচনার মাধ্যমে পরস্পরের বক্তব্য স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরতে। তাই এই ধরনের ‘ছোট’ প্ররোচনাকে গুরুত্ব না দিয়ে নওয়াজের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন তিনি।
কিন্তু তার পরেও ‘গ্রাম্য মহিলা’ মন্তব্য নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। দিল্লিতে কংগ্রেসও যথেষ্ট বিব্রত। কারণ, এমনিতেই রাহুলের মন্তব্য নিয়ে অস্বস্তি কাটাতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। তার উপর মোদী যে ভাবে মনমোহন-রাহুল ‘দ্বৈরথ’কে তুলে ধরতে নওয়াজ শরিফের মতো নতুন পাত্রকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করেছেন, তাতে সমস্যা বেড়েছে। ফলে তড়িঘড়ি ময়দানে নামেন কংগ্রেসের মুখপাত্র অজয় মাকেন। এক সাংবাদিক বৈঠকে মোদীকে পাল্টা নিশানা করে তিনি বলেন, “যে মোদী নিজেকে এত জাতীয়তাবাদী হিসেবে তুলে ধরেন, তিনিই আজ ভারতীয় সাংবাদিকের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে পাকিস্তানকে ভরসা করছেন? মোদী তো নিজেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর পাগড়ি খুলে দিলেন!” এক প্রাক্তন কূটনীতিক রসিকতা করে বলছিলেন, ক্রিকেটের পরিভাষায় বলে, ‘ক্যাচেস উইন ম্যাচেস’। ‘গ্রাম্য মহিলা’ নিয়ে যে খোঁচাটা উঠেছিল, তা অনবদ্য ভাবে লুফেছেন মোদী। কিন্তু ম্যাচ জিতবেন কি? তা সময়ই বলবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.