পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার তুলনায় মালদহের সীমান্তই কেন জাল নোট পাচারকারীদের বেশি পছন্দের? কেনই বা তারা বেছে নিচ্ছে কালিয়াচক ও বৈষ্ণবনগরকে?
কারণ অনেকগুলো। এমনিতে এখানে সীমান্ত লাগোয়া চর। কোথাও কোথাও কাঁটাতারের বেড়াও নেই। তার ওপর এখানে নোটের বাহক বা ‘কেরিয়ার’ খোঁজাও সহজ। সোনা, জরি, এমব্রয়ডারি, রং, মার্বেল ও রাজমিস্ত্রির কাজের মতো অসংগঠিত শিল্পে বংশ পরম্পরায় দক্ষ শ্রমিক হিসেবে পরিচিত এই এলাকার মানুষ। জম্মু বা হিমাচল থেকে কেরল, পঞ্জাব-গুজরাত থেকে নাগাল্যান্ডকাজের জন্য তাঁরা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন। পৌঁছে যান দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই বা হায়দরাবাদের মতো বড় শহরেও। এঁদের একটা অংশকেই মোটা কমিশনের বিনিময়ে কেরিয়ার হিসেবে বেছে নেয় জাল নোটের কারবারিরা। বিভিন্ন জায়গায় এই কেরিয়াররাই ধরা পড়ে জাল নোট নিয়ে।
ফরাক্কা ও মালদহ এই দু’টি বড় রেল স্টেশনের অবস্থানও এই অঞ্চল থেকে দেশজুড়ে জাল নোট ছড়ানোর কাজে সুবিধে করে দিচ্ছে বলে মনে করে পুলিশ ও বিএসএফ। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক কালিয়াচক ও বৈষ্ণবনগরের পাশ দিয়ে যাওয়ায় সড়ক পথেও জাল নোট ভিনরাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হয়। বিএসএফ-এর অতিরিক্ত ডিজি বংশীধর শর্মা বলেন, “মালদহ থেকে ভিনরাজ্যে যাওয়ার প্রচুর ট্রেন-বাস রয়েছে। বিহার-ঝাড়খণ্ডও কাছে। এই কারণেই জাল নোটের কারবারিরা মালদহকে বেছে নিচ্ছে।” |
এক লক্ষ টাকার জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে দিতে পারলে কমিশন হিসেবে মেলে আসল নোটে তিন হাজার টাকা। আবার হাজার বা পাঁচশোর জাল নোট আসল বলে চালিয়ে দিয়ে খুচরো হিসেবে যে আসল টাকা মেলে, সেটাও কেরিয়ারের লাভ।
সিআইডি-র বক্তব্য, বৈষ্ণবনগরের চর এলাকার চাঁইপাড়ার মতো গ্রামে জাল নোটের কারবার এক রকম কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। চাঁইপাড়ায় এমন বহু লোক আছে, জাল নোট নিয়ে যারা একাধিক বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “চাঁইপাড়ার মতো গ্রামগুলিতে কিছু মানুষ জাল নোট ছড়ানোর কাজে বিশেষ পারদর্শী। এক বার ধরা পড়ার পর জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের তারা এই কারবারে নামছে। মালদহকে জাল নোটের কারবারিদের পছন্দের এটাও একটা কারণ!”
পুলিশই স্বীকার করে নিচ্ছে, এখনও পর্যন্ত জাল নোটের কেরিয়াররাই শুধু ধরা পড়ছে, চাঁইদের ছোঁয়া যায়নি। কালিয়াচকের এক বাসিন্দার কথায়, “সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলিতে সম্প্রতি কিছু লোক দুমদাম পাকা বাড়ি ফাঁদছে, দামি মোটর গাড়ি, মোটর সাইকেল কিনছে। আন্দাজ করা যায়, জাল নোটের কারবার থেকেই এই রমরমা।”
এ সব জানার পরেও মালদহে জাল টাকার কারবার কিন্তু ঠেকানো যাচ্ছে না। কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর হাতে যত লোক শহরে জাল টাকা নিয়ে এসে ধরা পড়ে, তার নব্বই শতাংশই মালদহের বাসিন্দা। মালদহের পুলিশ সুপার কল্যাণ মুখোপাধ্যায় বলেন, “জাল নোটের বিষয়টি উদ্বেগজনক। পাঁচ জন পুলিশ অফিসারকে নিয়ে আমরা একটি বিশেষ তদন্তকারী দল তৈরি করেছি। এক জন ইন্সপেক্টর তার দায়িত্বে রয়েছেন।” শুধু জাল নোটের বিষয়ে তদন্তকারী দল তৈরি জেলায় এই প্রথম।
কিন্তু কেবল পুলিশি নজরদারি দিয়ে জাল নোটের এই কারবার ঠেকানো যাবে না বলে মনে করেন সিআইডি-র কর্তাদের একাংশ। আইবি-র এক শীর্ষ অফিসারও তাতে একমত। তাঁর কথায়, “জাল নোট ছড়ালে যে আখেরে দেশের অর্থনীতিরই ক্ষতি করা হয়, এই বিষয়টি নিয়ে মালদহের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলিতে প্রচার অভিযান করা দরকার। কারণ, জাল নোটের কারবারিদের জেরা করার সময়ে আমরা দেখেছি, অনেকেরই এই ব্যাপারে ধারণা নেই। তাদের কাছে এটা স্রেফ আইনকে ফাঁকি দিয়ে টাকা রোজগারের একটা উপায়। তারা যে দেশের বিরাট ক্ষতি করছে, এই বোধটুকু তাদের মধ্যে আনতে হবে।”
কিন্তু অন্যান্য কাজকর্মের চাপ সামলে পুলিশ এই কাজ কতটা করতে পারবে, সে ব্যাপারে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। |