এসেছিলেন পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্তব্যে। কিন্তু খালি পেটে যেমন ধর্ম হয় না, ভাঙা শরীরে রাজনীতিও কি হয়! তাই পার্টি কংগ্রেসের তর্ক-বিতর্কের ফাঁকেই হাসপাতালে শরীর-স্বাস্থ্যের আগাপাশতলা পরীক্ষা করিয়ে ফিরলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের ২৮ নেতা।
আসলে ফব নেতারা অভিনব কোনও কাণ্ড ঘটাননি। চেন্নাই এখন আম বাঙালির কাছে এমনই স্বাস্থ্য-তীর্থ, তার স্রোতের বাইরে থাকতে পারেননি রাজনীতির কুশীলবেরাও। কোচবিহারের বিধায়ক অক্ষয় ঠাকুর যেমন। উঠেছিলেন তামিলনাড়ুর বিধায়ক নিবাসে। এসে দেখেন, চেন্নাই জুড়ে ‘মাস্টার চেক আপে’র দারুণ চল। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। সোজা গিয়ে একটি মাল্টি-স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ‘মাস্টার চেক আপ’! সেই হাসপাতালেই জনসংযোগ এবং প্রশাসন বিভাগে কর্মরত আলম হোসেন। আদতে দিনহাটার ছেলে। নিজের পিতৃভূমির বিধায়কের কোনও অসুবিধা হতে তিনি দেননি। আলমের হাত ধরেই একে একে আরও অতিথি ভিড় জমিয়েছেন হাসপাতালে।
আলমও একা নন। দক্ষিণী এই শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল যেমন বাঙালি রোগীদের ভরসা স্থল, তেমনই স্বাস্থ্য ক্ষেত্র এবং তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পর্যটন শিল্প বহু বাঙালির কাছে কর্মসংস্থানের নিত্যনতুন সুযোগ এনে দিচ্ছে। চিকিৎসা করাতে আসা রোগী ও তাঁদের পরিজনদের জন্য রকমারি বাজেটের নানা গোত্রের হোটেল, গেস্ট হাউস এখন ছেয়ে ফেলেছে চেন্নাই। এবং সেখানে বিপুল সংখ্যায় কাজে আসছেন বাঙালি যুবকেরা। আলম যে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত, সেখানেই কর্মকর্তা হিসাবে আছেন আর এক জন বাঙালি। আবার তাঁদের ওখানে চিকিৎসা করাতে আসা লোকজনের থাকার জন্য গেস্ট হাউসের ব্যবস্থা করে দেন আলমই, যেখানে এই মুহূর্তে কাজ করছেন বাংলার ৭ জন। আলমের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরা থেকে বহু বাঙালি এখানে আসেন। স্টেশন থেকে তাঁদের পিক-আপ করে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা পুরোটাই আমরা করে দিই।”
একটি সূত্রের হিসাবে, প্রতি বছর ১২ থেকে ১৩ হাজার বাঙালি আজকাল চেন্নাই আসছেন চিকিৎসার জন্য। চেন্নাই শহরে মোট শয্যার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। এর অর্ধেকেরও বেশি কাজে আসে ভিন্ রাজ্যের রোগীদেরই। হাসপাতাল ছাড়াও শহরের আনাচে-কানাচে অজস্র ডায়াগনিস্টিক সেন্টার। এক বার ঢুকে পড়লে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত পরীক্ষা করিয়ে বেরিয়ে আসা যায়! আবার বাজেটেরও রকমফের পাওয়া যায় সব ধরনের মানুষের জন্য। চেন্নাই শহরেরই নামী বেসরকারি হাসপাতালে যে অস্ত্রোপচারের দক্ষিণা পড়বে ১ লক্ষ টাকা, মাঝারি হাসপাতালে সেই কাজই ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় হবে। চেন্নাইয়ে এলে গ্যাস-অম্বল-বদ হজমে ভোগা বাঙালি সাধারণ চেক আপও করিয়ে যেতে ছাড়ছেন না! উত্তরবঙ্গ থেকে এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে সন্তুষ্ট আব্দুর রউফের প্রতিক্রিয়া, “এখানে ব্যবস্থা অনেক উন্নত। সাহায্য করার কেউ থাকলে দিশাহারাও লাগে না!”
ফ ব-র পার্টি কংগ্রেস চলাকালীনই এক রাতে সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন দলের নবতিপর নেতা অশোক ঘোষ। রাতেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরিচর্যার ব্যবস্থা করতেও এগিয়ে এসেছিলেন প্রবাসী বাঙালিরা। অশোকবাবু অবশ্য ইদানীং চেন্নাইয়েই বাৎসরিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে যান।
আবার এই স্বাস্থ্য পরিষেবার রমরমার দৌলতে হোটেল ব্যবসার যে সমৃদ্ধি, তাতেও জুড়ে রয়েছেন বাঙালিরা। নানা মাপের হোটেলে কাজ জুটিয়ে এখানে রয়েছেন বাংলা, ত্রিপুরা, অসম বা ওড়িশার বহু মানুষ। নানা গেস্ট হাউসের কিচেনেও বাঙালি। পুরোদস্তুর বাঙালি রেস্তোরাঁ চালানোর লোকও মোটেই অমিল নয়। তাঁদের বক্তব্য, “এখানকার মাছ এবং মশলা অন্য রকম। তবু আমরা বাঙালি কায়দাতেই রান্নাটা করি।”
আগে চেন্নাইয়ের একটি নির্দিষ্ট জায়গাই (ওয়ালাজা রোডকে ঘিরে) বাঙালি বসতি হিসাবে মূলত পরিচিত ছিল। এখন বাঙালির বিস্তার নানা প্রান্তেই! আর এর সঙ্গেই বেড়েছে বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন। পুরনো-নতুন মিলিয়ে চেন্নাইয়ে এখন ৮টি বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন। প্রতিটার সঙ্গে দুই থেকে আড়াই হাজার ব্যক্তি জড়িত, পরিবার বাদ দিয়ে। এদের মধ্যে টি নগরে প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের বিরাট চত্বর প্রতি বছর দুর্গা থেকে সরস্বতী, সব পুজোই উদযাপন করে। উপর তলায় এসি এবং নন-এসি কিছু ঘর। অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে জড়িত কারও প্রয়োজন হলে ওই ঘরে থাকার ব্যবস্থা। সঙ্গে ক্যান্টিন। সেখানে বাঙালি হাতে বাঙালি রান্নার ব্যবস্থা! নির্মাণ, চামড়া বা বস্ত্রশিল্পে জড়িত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা অবশ্য এ সব অ্যাসোসিয়েশনের আওতার বাইরে। তবু চেন্নাইয়ের বাঙালি-যজ্ঞে তাঁরাও আছেন।
টি নগরের অ্যাসোসিয়েশনের তরফে দমদম ক্যান্টনমেন্টের আদি বাসিন্দা সুরম্য দাশগুপ্তের সহাস্য গর্ব, “কলকাতার চেয়ে আমরা কিন্তু বেশি বাঙালি!” |