ধরে নেওয়া যায় রোববারের সকালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বার্ষিক সাধারণ সভায় পৌরোহিত্য করতে বসবেন ট্রেডমার্ক সাফারি স্যুটে। ধরে নেওয়া যায় এগারোটা এক বা এগারোয় অন্য বারের মতো মিটিং শুরু না করে এগারোটায় করার অর্থ, বিশ্বাসভাজন জ্যোতিষী ওই সময়টা ঠিক করেছে। ধরে নেওয়া যায় রাত্তিরটা চেন্নাইয়ে থেকে যাওয়া গুটি কয়েক বোর্ড সদস্যের সঙ্গে আড্ডায় তিনি জাঁকিয়ে বসবেন ঠোঁটে পাইপ, হাতে ব্লাডি মেরি-র গ্লাস নিয়ে।
ক্রিকেটমহলে কে না জানে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের প্রশান্তির এই হল অমোঘ অভিযান!
প্রশান্তিকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী তৃতীয় ইনিংস রোববার শুরু করছেন কোন পরিস্থিতিতে! না, পারিবারিক সম্পর্ক ঘিরে তীব্র লজ্জাকর পরিস্থিতি, ম্যাচ ফিক্সিং ভ্রুকুটি, সিবিআইয়ের রোষ, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের বৈরিতা, প্রতিকূল কেন্দ্রীয় সরকার, বিরূপ সুপ্রিম কোর্ট এবং আক্রমণাত্মক জাতীয় মিডিয়া এতগুলো প্রতিপক্ষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
এদের মধ্যে মিডিয়ার প্রতি তাঁর রাগ সবচেয়ে গরগরে। শনিবার চেন্নাইয়ে জাতীয় চ্যানেলের এক প্রতিনিধিকে ফোনে তিনি ধমকেছেন, আজ ব্যাপারটা যে এই পর্যায়ে এসেছে, তার নাটের গুরু তোমরা। তোমাদের ইন্ধন জোগাবার জন্যই আজ সুপ্রিম কোর্ট এ সব বলছে। প্রতিনিধি পরে বলছিলেন, কী রাগ রে বাবা। পারলে ফোনেই কুকুর লেলিয়ে দেয়। এ দিন বিকেলে পার্ক শেরাটন টাওয়ার থেকে বেরিয়ে যখন গাড়িতে উঠছেন, এক সাংবাদিক গাড়ির কাচের ভেতর দিয়ে প্রশ্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। শ্রীনি তাঁর দিকে না তাকিয়েই আঙুল ঘোরান, ধ্যাৎ যাও এখান থেকে। সব দেখেশুনে চেন্নাইয়ে বোর্ড ইলেকশন কভার করতে আসা রিপোর্টারদের মনে হচ্ছে আসন্ন অস্ট্রেলিয়া ওয়ান ডে সিরিজে প্রেসবক্সে জলের ব্যবস্থাও থাকবে তো?
সাংবাদিকদের প্রতি বদলা নেওয়ার সুযোগ অবশ্য এখুনি হাতে কিছু নেই। যাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া যায়, তাদের সম্পর্কে চটজলদি কাজ এ দিনই শুরু করে দিলেন শ্রীনি। সৌরাষ্ট্রের নিরঞ্জন শাহ তাঁর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। নিরঞ্জনকে দ্রুত (পশ্চিমাঞ্চলের) ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। ওটা দেওয়া হল তাঁর অনুগত রবি সবন্তকে। বিদর্ভের সুধীর দাবির ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মধ্যাঞ্চল প্রতিনিধি। তিনি শশাঙ্ক মনোহরের স্নেহধন্য, তাই দ্রুত সরিয়ে দেওয়া হল। এঁরা যেমন কৃতকর্মের ‘কুফল’ পেলেন, তেমনই কৃতকর্মের লয়্যালটি বোনাস দেওয়া হল একাধিক সদস্যকে। হরিয়ানার অনিরুদ্ধ চৌধুরী মুখের ওপর মনোহরকে বলেছিলেন, স্যর আপনাকে ঠকাব না। আমি শ্রীনি-সমর্থক। এত বড় সত্য ভাষণের জন্য অনিরুদ্ধ মনোনীত হলেন কোষাধ্যক্ষ। কথা ছিল, অনিরুদ্ধকে আইপিএল চেয়ারম্যান করে ভ্রাতৃপ্রতিম এবং চিরবিশ্বস্ত রঞ্জীব বিসওয়ালকে কোষাধ্যক্ষ বানাবেন। কিন্তু বেঁকে বসেন জগমোহন ডালমিয়া। বলেন, বাংলা কিছুই পেল না, তা হলে ওড়িশাই বা এত বড় পোস্ট পাবে কেন?
শ্রীনির সঙ্কটের সময় যখন মনোহর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন এই পরিস্থিতিতে সিএবি দুই ভোট-সহ তাঁর পাশে ছিল। ডালমিয়া শুধু অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নানান অসম্মানই মুখ বুজে সহ্য করেননি, এক বারের জন্যও গত ছ’মাসে ফোঁস করেননি। পাছে শ্রীনি রেগে যান। শ্রীনি যে সেই আনুগত্যের কোনও দাম দেননি, তাঁর প্যানেল মনোনয়ন এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বাংলাকে তিনি কোনও ভাল পদ দেননি। অনেকে ভাবছিলেন, ডালমিয়া ‘লয়্যালটি বোনাস’ পাবেন আইপিএল চেয়ারম্যান হিসেবে। অথচ শনিবার মাঝ রাত্তির অবধি সেটা নিয়ে কোনও কথাই পাড়লেন না। বরঞ্চ সংশয় রেখে দিলেন আইপিএল প্রধান কাকে করবেন। ডালমিয়া? বিশোয়াল? না কি গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ? আর পূর্বাঞ্চলের মধ্যে প্রকারান্তরে হঠাৎ করে ঝগড়াও বাধিয়ে দিলেন।
এ দিন শ্রীনি নিজে থেকে রঞ্জীব বিসওয়ালকে বলে দেন স্রেফ ডালমিয়ার আপত্তিতেই তোমাকে ট্রেজারার বানাতে পারলাম না। যা শুনে উত্তেজিত বিসওয়াল পূর্বাঞ্চলীয় মিটিংয়ে আসা সিএবি-র দুই প্রতিনিধি বিশ্বরূপ দে আর সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়কে বলতে থাকেন, এটা কী ধরনের অসভ্যতা? আমাকে মুখোমুখি না বলে কেন পিছন থেকে কলকাঠি নাড়া হল? এর পর ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা একজোট হয়ে চেঁচাতে থাকে, “বাংলা থেকে কেন এনসিসি ওয়ার্কিং কমিটিতে যাবে? মরা একটা সংস্থা? কী করে ওরা ক্রিকেট নিয়ে যে ওদের টার্ন আমরা মানব? আমরা প্রতিবাদ করব মিস্টার শ্রীনিবাসনের কাছে।”
এমনিতেই বোর্ড সভা থেকে বাংলার ভাগ্য এ বার ভাঁড়ে মা ভবানী। তার ওপর আবার পূর্বাঞ্চলীয় জোট এ ভাবে ভেঙে খানখান হয়ে যাওয়ায় সিএবি আরও চাপে পড়ল। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, ইচ্ছাকৃত ভাবে এটা শ্রীনি করলেন। তৃতীয় ইনিংস শুরুর আগের দিন তিনি চতুর্থ ইনিংসেও ব্যাট করার ইটটা পেতে দিলেন। এ বার যেমন দক্ষিণের টার্ন। পরের বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার টার্ন তো পূর্বাঞ্চলের। অ্যাদ্দিন শ্রীনি আর সিএবি কর্তাদের মধ্যে হনিমুনের এক্সটেনশন হয়েই যাচ্ছিল। শনিবার তাঁরা অকস্মাৎ আবিষ্কার করেছেন, আরে এই লোকটা তো আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনও দামই দিল না। উলটে অসম-ঝাড়খণ্ড-ত্রিপুরাকে এমন হাত করে ফেলল যে পরের বছর ওখান থেকে আবার প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। কেউ কেউ রাগত ভাবে এমনও বলছিলেন, “আমাদের উচিত কোনও কমিটি-টমিটি দিলে স্ট্রেট না বলা। ভেবেছেটা কী?” প্রশ্ন হল, সাহসে কুলোবে তো শেষ পর্যন্ত?
আদিত্যপ্রতাপ বর্মা এ দিন দিল্লিতে বসে তাঁর সেলফোনে হঠাৎ এমন একটা নম্বর ভেসে উঠতে দেখেন যা বিস্মিত করার মতো। কলারের নাম জগমোহন ডালমিয়া। ডালমিয়া নাকি এর পর তাঁকে বলেন, ভাল লড়ছ তুমি। চালিয়ে যাও।
এই ফোনালাপ সত্যি হলে বোর্ড রাজনীতিতে আকস্মিক এক বাঁক। রোমহর্ষকও। অভিজ্ঞমহলের অবশ্য মনে হচ্ছে সত্যি হলেই বা। রোমহর্ষক হলেই বা কী। স্ট্রোকটা এত দেরিতে খেলা হল যে আর কোনও মাহাত্ম্য অবশিষ্ট থাকল কি না সন্দেহ!
ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এ দিন অরুণ জেটলির নাম জমা না পড়ায় মৃদু চাঞ্চল্য তৈরি হয়। কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেন, তা হলে কি জেটলি সরে গেলেন শ্রীনির পাশ থেকে? নইলে নিজের নাম নিজেই তুলে নেবেন কেন? দিল্লি ক্রিকেটমহল অবশ্য মনে করে সরে গেলেন নিজের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য। বারবার করে নানান মামলায় কলঙ্কিত মানুষের সঙ্গে প্রকাশ্য নাম জড়ানোটা তিনি চান না। অন্তরালে যদিও শ্রীনিবাসন শিবিরের ‘কৃষ্ণ’ হয়েই তিনি রয়েছেন। শেষ মুহূর্তে জেটলি পরিত্যাগ না করলে তো মনোহরেরও শনিবার মনোনয়নপত্র জমা পড়ত! জেটলির বশংবদ, বিজেপি সদস্য এবং অন্ধ্রপ্রদেশ সংস্থার কর্তা গঙ্গা রাজু এ দিন লুঙ্গি-টুঙ্গি পরে তামিল ছবির হিরোর মতো ঘুরছিলেন। তাঁকে ভাল একটা কমিটির চেয়ারম্যান করে দিচ্ছেন শ্রীনি। গঙ্গা রাজুই তো এ বারের বোর্ড নির্বাচনের টার্নিং পয়েন্ট! তিনি একই সঙ্গে দুই প্রার্থীর মনোনয়নপত্রে সই করে দেওয়াতেই তো মনোহর আটকে গেলেন। দক্ষিণাঞ্চল থেকে দ্বিতীয় কাউকে নিজের সমর্থনে পেলেন না। শুনলাম, গঙ্গাকে একাধিক কমিটিতে রাখতেও শ্রীনির আপত্তি নেই।
চেন্নাইয়ে দুপুর-বিকেলে যখন বোর্ড নির্বাচনের প্যাঁচ পয়জার আর কাঠামো তৈরি হচ্ছিল, তখন দিল্লির ডিফেন্স কলোনির বাড়িতে ছুটির মেজাজে থাকা ট্র্যাকস্যুট আর টি-শার্ট তাঁর মক্কেলকে আশ্বস্ত করছিলেন, সোমবার দেখুন না সুপ্রিম কোর্ট শ্রীনিকে কী বলে। ভদ্রলোকের নাম হরিশ সালভে। বোর্ড নির্বাচনে ওয়াকওভার পেলেও চূড়ান্ত নির্বাচন যেন শ্রীনিকে সালভের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে সোমবারের সুপ্রিম কোর্টে। |