খেল সম্মান নিয়ে ফেরার সময় এভারেস্টজয়ী ছন্দা গায়েনকে মঞ্চেই ডেকে তাঁর জীবনের কথা শুনছেন বাংলার খেলাধুলোর আইকন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়! পরে নিজের জীবনকৃতি সম্মানের সঙ্গে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকার চেক দিয়ে গেলেন ছন্দা এবং দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের সাহায্যের জন্য।
লিয়েন্ডার পেজের লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার এবং নিজের ক্রীড়াগুরু সম্মান পিতা এবং কোচ হিসেবে রাজ্য সরকারের দেওয়া দু’টি পুরস্কার নেওয়ার পর ভেস পেজের গলায় উচ্ছ্বাস, “গ্রেট অনার। ছেলে এবং নিজের দু’টি পুরস্কার প্রাপ্তি, অসাধারণ অভিজ্ঞতা!”
’৪৮-এর লন্ডন, ’৫২-এর হেলসিঙ্কি অলিম্পিকের সোনাজয়ী হকি দলের সদস্য কেশব দত্তের চেয়ারের সামনে যখন স্মারক, উত্তরীয় ও চেক নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন তিরাশি বছরের মানুষটি হাতজোড় করেই আবেগে কাঁপছেন। আর উঠতে চেষ্টা করছেন চেয়ার ছেড়ে!
রাজ্যের সর্বাধিক ব্যক্তিগত পদক যাঁর ঝুলিতে, সেই জিমন্যাস্ট টুম্পা দেবনাথ এক কোণে বসেছিলেন জড়সড় হয়ে। মঞ্চে বসে থাকা পঞ্চাশ ভাগ ক্রীড়াবিদ যে তাঁকে চেনেনই না। রাজ্যের উপর ক্ষোভে এক সময় ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন বাংলা। তারকা-খচিত নেতাজি ইন্ডোরের মঞ্চে এ রকম স্বীকৃতি নিতে এসে নবদ্বীপের রিকশা চালকের মেয়ে টুম্পার চোখে জল,“দারুণ লাগছে, দারুণ। স্বপ্ন মনে হচ্ছে।” |
নেত্রীর খেলা
নেতাজি ইন্ডোরে রাজ্যের ক্রীড়াবিদদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী। |
ফুটবলার-সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে মঞ্চেই ফুটবল নাচালেন সৌরভ। নাচিয়েই যাচ্ছেন। ‘রেফারি’ মুখ্যমন্ত্রী হাসতে হাসতে বললেন, “প্রসূন, তুমি কিন্তু হেরে গেছ সৌরভের কাছে।”
ফুটবলে অর্জুন, শান্তি মল্লিকের ফুটবল-নাচানো দেখে মুখ্যমন্ত্রী উচ্ছ্বসিত। “আরে দেখুন মেয়েরা কী করতে পারে। আমি মেয়েদের টিমকেও এ বার অর্থ সাহায্য করব।”
রাজ্যের নামী প্রাক্তন অ্যাথলিট ও কোচ মনোরঞ্জন পোড়েল স্মারক এবং চেক নেবেন কী, হাতজোড় করে দাঁড়িয়েই আছেন মুখ্যমন্ত্রীর সামনে। জীবনে প্রথম কোনও বড় স্বীকৃতি পেলে যা হয়! ক্রীড়ামন্ত্রীর ডাকে সম্বিত ফিরল তাঁর। নিলেন পুরস্কার।
এ রকম অসংখ্য টুকরো টুকরো ঘটনার কোলাজ শনিবার দুপুরে দেখা গেল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে, রাজ্য ক্রীড়া দফতরের মঞ্চে। ক্লাবগুলিকে দেদার টাকা বিলোনো নিয়ে তীব্র ঝড়, সম্মান প্রাপক বাছা নিয়ে ঝামেলা, নির্বাচকদের নিজেদেরই পুরস্কার প্রাপক হয়ে যাওয়া সব বিতর্ক যেন পিছনে পড়ে গেল চমকপ্রদ এই অনুষ্ঠানের পর। রাজ্যের খেলাধুলোর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়ে একই সঙ্গে ৬৪ ক্রীড়াবিদকে এক মঞ্চ থেকে পুরস্কৃত করল রাজ্য সরকার। অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, পঞ্জাব, এমনকী মণিপুরেও সেখানকার রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা মোড়কে ক্রীড়াবিদদের সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে বহু দিন। কিন্তু বাংলায় এ রকম স্বীকৃতির ব্যবস্থাই ছিল না এত দিন। মুখ্যমন্ত্রী বলেও দিলেন, “সবে শুরু হল। বাংলাকে খেলাধুলোয় বিশ্বের এক নম্বর করতে হবে। পরের বার পাঁচ জনকে লাইফটাইম পুরস্কার দেব।”
মোট চারটি বিভাগ করা হয়েছিল পুরস্কারের জন্য। এক) খেল সম্মান যা দেওয়া হল বর্তমান ক্রীড়াবিদদের। পেলেন জয়দীপ কর্মকার-নবি থেকে পৌলমী ঘটক-মাম্পি, লক্ষ্মীরতন শুক্ল-ভরত ছেত্রী থেকে অরূপ বৈদ্য-অপর্ণা ঘোষরা। দুই) ক্রীড়াগুরু সম্মান যা দেওয়া হল মূলত কোচেদের। পেলেন অমল দত্ত-নইমুদ্দিন থেকে সুভাষ ভৌমিক-সুব্রত ভট্টাচার্যরা। তিন) বাংলার গৌরব যা দেওয়া হল মূলত প্রাক্তনদের। পেলেন কেশব দত্ত, সোমা বিশ্বাস, উৎপল চট্টোপাধ্যায়রা। এবং ঝুলন গোস্বামীও। প্রয়াত দুই ফুটবলার কৃশানু দে ও সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হল মরণোত্তর সম্মান। চার) লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পেলেন সৌরভ ও লিয়েন্ডার। স্মারক, ব্লেজার, ফলের ঝুড়ি এবং চেক দেওয়া হল সবাইকেই। পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হল ক্রীড়াবিদদের। রাজ্য ফুটবল অ্যাকাডেমি ও ক্রীড়া দফতরের ওয়েবসাইটেরও উদ্বোধন হল। |
নানা ফ্রেম |
|
|
প্রসূন-গৌতমদের
সঙ্গে ‘ফুটবলার’ সৌরভ। |
মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে
স্মারক নিচ্ছেন ভেস পেজ। |
|
রাজ্যের ক্রীড়াবিদদের নিয়ে এ রকম একটা নতুন অনুষ্ঠানের মধ্যে চোনা যে পড়েনি, তা কিন্তু নয়। ভারোত্তোলন, কুস্তি, বডি বিল্ডিং, শক্তিত্তোলন-এর মতো খেলার প্রচুর অর্জুন বা নামী খেলোয়াড় থাকলেও তাঁদের পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়নি। পুরস্কার দেওয়ার সময় কাকে আগে দেওয়া হবে এবং কী দেওয়া হবে, তা নিয়ে নানা বিসদৃশ ঘটনা ঘটল মঞ্চেই। এক পুরুষ সঞ্চালক ভুল সঞ্চালনার পাশাপাশি বারবার ছবি তোলার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চলে যাচ্ছিলেন। ক্লাবের অনুদান নিতে আসা লোকজনদের খাবারের প্যাকেটের জন্য হুড়োহুড়ি। বাংলার খেলাধুলোর প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিওএ-র প্রেসিডেন্ট মুখ্যমন্ত্রীর দাদা অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতি এ রকম নানা ঘটনায় তাল কেটেছে অনুষ্ঠানের। প্রাপক বাছা নিয়ে বিতর্ক থামাতে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র এ দিন স্বীকার করে নিয়েছেন যে, পুরস্কার তালিকা থেকে অনেকে বাদ পড়েছেন। “প্রাপক বাছা প্রচণ্ড কঠিন। ৬৫ ভাগকে দিয়েছি। যাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁদের পরের বার দেব,” বলেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী।
কিন্তু নির্বাচকরা কেন নিজেরাই নিজেদের বাছলেন পুরস্কারের জন্য? কেনই বা তা নিতে মঞ্চে উঠলেন? তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ক্রীড়ামন্ত্রী। কেন নির্বাচক কমিটিতে থাকা গৌতম-বিদেশ-সোমারা পুরস্কার নিলেও সৌরভ-ভাস্করের মতো মানসিকতা দেখাতে পারলেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সৌরভের পথ অনুসরণ করে প্রাক্তন ফুটবলার ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ও তো তাঁর পাওয়া এক লাখ টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করে গেলেন দুঃস্থ খেলোয়াড়দের সাহায্যের জন্য। কিন্তু ওঁরা সেটা পারলেন কই! |