প্রশাসনিক বৈঠকের মঞ্চ থেকেই সচিবকে সরালেন মমতা
মলাদের উদ্দেশে এর আগে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা ছিল, ‘কাজ না পারলে চলে যান। আমি বুঝে নেব।’ এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের মঞ্চ থেকেই রাজ্যের এক সচিবকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে সেই সচিব এখন বিদেশে। বৈঠকে নিচু তলার অফিসারদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, “যাঁরা কাজ করছেন না, তাঁদের চিহ্নিত করা হবে। রাইট টু সার্ভিস আইনে জরিমানা করা হবে” বিভাগীয় সচিবদের সেই দিকে নজর রাখতেও নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার ঝাড়গ্রামে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। জেলায় ১০০ দিনের কাজ-সহ বিভিন্ন জনস্বার্থ বিষয়ক প্রকল্পের অগ্রগতির হাল তাঁকে খুশি করতে পারেনি। রীতিমতো বিরক্ত হয়ে অফিসারদের তিনি বলেন, “যাঁরা মানুষের কাজ করেন না, তাঁরা তো অমানুষ!” তাঁর সাফ কথা,“আমি কোনও অজুহাত শুনব না। কাজগুলো করতে হবে। কোনও গাফিলতি বরদাস্ত করব না আমি। সব নজর রাখছি।”
তাঁর এই সতর্কবাণী শুধু একটি জেলার ক্ষেত্রে নয়, সর্বত্রই প্রযোজ্য বলে প্রশাসনের কর্তারা মনে করছেন।
এ দিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব-সহ একাধিক সচিব। ছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। জঙ্গলমহল ঘেরা এই জেলায় গত দু’বছরে নানা ধরণের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বাম আমলে মাওবাদীদের যথেষ্ট প্রভাব থাকায় উন্নয়নে কাজে এই জেলাকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে মহাকরণ। রাজ্য প্রশাসনের দাবি, গত দু’বছরে প্রচুর কাজ হয়েছে এই জেলায়।
ঝাড়গ্রামের প্রশাসনিক বৈঠকের আগে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে তাঁর ছবিতে মাল্যদান মুখ্যমন্ত্রীর।
মানুষও তাতে খুশি। আর এই উন্নয়নের কাছে হার মেনেছে মাওবাদীদের বন্দুক। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এবার ঘুরলেন জঙ্গলমহলে এক সময়ের মাওবাদী-অধ্যুষিত প্রত্যন্ত এলাকাগুলি। কথা বলেন তাঁর চলার পথে দাঁড়ানো সাধারণ মানুষের সঙ্গে। তখনই তিনি বুঝতে পারেন, প্রশাসনিক গাফিলতি ও অকর্মণ্যতার জন্য অনেক কাজ সময়ে করা হচ্ছে না। এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই মুখ্যমন্ত্রী ওই কঠোর পদক্ষেপ করলেন বলে বলে মনে করছেন সরকারি কর্তারা।
রাজ্যের কারিগরি শিক্ষা দফতরের কাজকর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন জেলার বৈঠকে অসন্তোষ জানাচ্ছিলেন মমতা। এ দিন ঝাড়গ্রামে তা চরমে ওঠে। বিভাগীয় সচিব হৃদেশ মোহনের উদ্দেশে তিনি জানতে চান, এই জেলায় আইটিআই তৈরির কাজ কতদূর? জানা যায়, সচিব এখন জার্মানিতে। পরিবর্তে হাজির ছিলেন তাঁর এক অধীনস্থ অফিসার। ‘স্ট্যাটাস রিপোর্ট’ দিয়ে ওই অফিসার জানান, শালবনি ও ঘাটালে কাজ চলছে। বাকি গুলির মধ্যে কয়েকটির জন্য জমি দেখা চলছে, কয়েকটির টেন্ডার ডাকা হয়েছে।
এই জবাবে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি লো স্ট্যাটাসের লোক। আমাকে ও সব স্ট্যাটাস দেখাবেন না। কে বড় অফিসার, কে ছোট অফিসার-- আমার জানার দরকার নেই। আমার স্ট্যাটাস হল মানুষ। এটা চ্যাংড়ামির জায়গা নয়, এটা কাজ করার জায়গা। বলতে বলতে আমার মুখে রক্ত উঠে যাচ্ছে। না পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দিন। আমি বলে দিলাম, পুজোর মধ্যে কাজ শেষ (খাতায়-কলমে) করতে হবে। তার পর আমি শিলান্যাস করব।” এরপরই বৈঠক-মঞ্চ থেকেই মমতা উচ্চ শিক্ষা দফতরের প্রধান সচিব বিবেক কুমারকে নির্দেশ দেন, “কাল থেকেই আপনি অতিরিক্ত ভাবে কারিগরি শিক্ষা দফতরের কাজকর্ম দেখবেন। আমি কাজ চাই।”
মুখ্যমন্ত্রীর দু’দিনের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সফর শেষ হল। বৃহস্পতিবার প্রায় আড়াই ঘণ্টা টানা
বৈঠকের পরে এসপি অফিসের সামনেই সাংবাদিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেখানে জঙ্গলমহলের উন্নয়নে জোর দেওয়ার পাশাপাশি ঝাড়গ্রামে পর্যটনকেন্দ্র বিকাশের কথা বলেন।
মুখ্যমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের তালিকায় যে একশো দিনের কাজ, মিড-ডে-মিল, সুসংহত শিশুবিকাশ প্রকল্প (আইসিডিএস) এবং নিজ ভূমি-নিজ গৃহ প্রকল্প রয়েছে, বৈঠকে সে কথা জানান তিনি। পশ্চিম মেদিনীপুরে এই প্রকল্পগুলির হাল কী, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মমতা। যেমন, ১০০ দিনের কাজ। বুধবার শিলদা থেকে ঝাড়গ্রাম যাওয়ার পথে গোপীনাথপুর গ্রামে আচমকা ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। কথা বলেন সেখানকার কিছু বাসিন্দার সঙ্গে। জানতে পারেন, তাঁরা একশো দিনের কাজ করলেও এখনও টাকা পাননি। অভিযোগ শুনে মুখ্যমন্ত্রী তখনকার মতো তাঁদের বলেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য হয়তো এতদিন আপনারা টাকা পাননি। এ বার পেয়ে যাবেন।” কিন্তু এটা যে তাঁর মনোমত উত্তর নয়, এ দিনের বৈঠকে সে কথা বুঝিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “দু’মাস হল পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ হয়েছে। তা হলে কেন মানুষ কাজ করেও টাকা পাবেন না? কেন আপনারা গরিব মানুষের টাকা আটকে রাখবেন?”
ঝাড়গ্রামের তৃণমূল নেতা লালমোহন মাহাতোকে ২০১১ সালে গুলি করে হত্যা করে মাওবাদীরা। সেই সময় তাঁর পরিবারকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। তার পর প্রায় দু’বছর অতিক্রম করলেও লালমোহনের পরিবারের কাছে সেই সাহায্য পৌঁছোয়নি। বুধবার ঝাড়গ্রামের পথে সেই প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রয়াত নেতার স্ত্রী একটি স্মারকলিপি তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। জেলা প্রশাসনের বৈঠকে সেই প্রসঙ্গ তুলেও মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান, “আবেদন করেও ওঁরা কেন সাহায্য পাননি? কোন স্তরে, কার কাছে আটকে রয়েছে ফাইল?”
এর পরেই তাঁর মন্তব্য, “যাঁরা কাজ করছেন না, তাঁদের চিহ্নিত করুন। নিচুতলায় ফাইল আটকে থাকছে। কেন উপরের তলায় পৌঁছবে না? কারা এ সব করছেন আমি কিন্তু জানি। কো-অর্ডিনেশন কমিটির কিছু লোক। সব নজর রাখছি। ফল কিন্তু ভাল হবে না।”
জেলাস্তরের অফিসারদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ,“মানুষের সঙ্গে কথা বলুন, তাঁদের কাছে যান। দয়া করে শুধু অফিসে বসে থাকবেন না। মনে রাখবেন, মানুষের সঙ্গে কথা না বললে সত্য ও প্রকৃত ঘটনা জানা যায় না। আমি মানুষের সঙ্গে মিশি, তাঁদের কাছে যাই। এখানে আসার পথেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি।” বৈঠকে হাজির সংশ্লিষ্ট বিভাগের অফিসারদের কাছে সরাসরি তাঁর প্রশ্ন ছিল, “ক’দিন আপনারা শিশুবিকাশ কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন? ক’দিন নিজেরা মিড-ডে-মিল খেয়েছেন?” জেলায় স্কুলের নানাবিধ উন্নয়নের কাজেও যে তিনি সন্তুষ্ট নন, তাও জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী।

ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.