প্রবন্ধ...
ভারত নিজের তৈরি করা গর্তে পড়েছে
বেলা না যেতে খেলা কি ঘুচে গেল? ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ে এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই এখন। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বৃদ্ধির হার কমেই চলেছে। বাড়বে, তেমন লক্ষণ নেই। তার পাশাপাশি প্রবল মূল্যস্ফীতি চলছে। ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম অনেকখানি কমেছে। যাচ্ছি কোথায় আমরা?
কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি— এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে ভারতের ‘চোখধাঁধানো আর্থিক বৃদ্ধি’-র সময়টার দিকে তাকাতে হবে। অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন, গোটা দুনিয়া জুড়ে যে আর্থিক ধ্বংসলীলা চলছে, ভারত নিজেকে তার ছোঁয়াচ থেকে বাঁচাতে পেরেছে। সেই বিশ্বাসের ভিত্তি আজ নড়ে গিয়েছে। গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি যে ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ভারতও তাতেই ডুবছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে চিন যে ভাবে যুক্ত, ভারত সে ভাবে নয়। বিশ্ব-অর্থনীতির সঙ্গে চিনের যোগ তার পণ্য রফতানির মাধ্যমে। ভারতের ক্ষেত্রে পণ্য বা পরিষেবা রফতানি যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ এবং অন্যান্য আর্থিক লগ্নি— পরিভাষায় যাকে ‘ফিন্যান্স’ বলা হয়। এই ফিন্যান্স-ই ভারতকে বিশ্ব-অর্থনীতির সঙ্গে জুড়ে রেখেছে। এই কারণেই চিনের তুলনায় ভারত বিপজ্জনক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
, ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গল্পটি দাঁড়িয়ে আছে মূলত আর্থিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সংস্কারের ওপর। একের পর এক নিয়ন্ত্রণ উঠে গিয়েছে। অন্য দিকে, সমাজে আর্থিক অসাম্য ক্রমশ বেড়েছে। ফলে, বৃদ্ধি যা হয়েছে, তার একটা বড় অংশ উচ্চবিত্তের ধার করে ভোগ ব্যয়ের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার ফল। এই আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে গরিব মানুষের ভোগব্যয় বৃদ্ধির সম্পর্ক ক্ষীণ। ১৯৯৬ সালে ভারতে ব্যাঙ্কগুলির দেওয়া মোট ঋণের মধ্যে ‘পার্সোনাল লোন’-এর অনুপাত যা ছিল, ২০০৮ সালে তা দ্বিগুণ হয়েছে। ভোগব্যয় কারা বাড়িয়েছেন, এবং কোন পথে বাড়িয়েছেন, তার ইঙ্গিত এই পরিসংখ্যানটি থেকে পাওয়া সম্ভব। অনেকেই ‘চুঁইয়ে পড়া উন্নয়ন’-এর কথা বলছেন। চুঁইয়ে পড়তে হলে ওপরের স্তরে যে প্রভূত সমৃদ্ধি জমতে হয়, সংশয় নেই!

পরখ। ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম তলানিতে এসে ঠেকেছে। ছবি: এপি।
, ধারে ভর করে যে চাহিদা বাড়ে, সেই ঋণ দেওয়ার জন্য বাজার স্বল্পমেয়াদে এক ধরনের নিশ্চয়তা দেখতে চায়— জমি-বাড়ির ক্রমবর্ধমান দাম সেই নিশ্চয়তা জুগিয়েছে।
, ভারতের বাজারে যে অতিচঞ্চল পুঁজি ঢুকেছে (পরিভাষায় যাকে ‘হট মানি’ বলে মূলত বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ), তার সঙ্গে জমি-বাড়ির ক্রমবর্ধমান দামের সম্পর্ক গভীর। সম্পত্তির বাজারের মতোই ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রেও একই ধরনের ছবি তৈরি হয়েছে— এখানেও বাজার মূলত ঋণের ওপর ভর করেই চলেছে। তার ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঋণের গুরুত্ব বিপুল হারে বেড়েছে।
, ভারতের রফতানি মূলত পরিষেবা-নির্ভর। তথ্যপ্রযুক্তিই হোক অথবা আর্থিক ক্ষেত্র, ভারতের পরিষেবা রফতানি দাঁড়িয়ে আছে বিদেশি কাজ চালানের পরিমাণের ওপর।
, ভারতে যে আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে, কর্মসংস্থান হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম। তার কারণ, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি এক দিকে উচ্চবিত্তের ভোগব্যয় আর অন্য দিকে বিদেশি বাজারে পরিষেবা রফতানির ওপর নির্ভরশীল। উভয় ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির ধ্বংসের বীজ তো তার মধ্যেই নিহিত ছিল গোড়া থেকে।
উচ্চবিত্তদের ভোগব্যয়-নির্ভর বৃদ্ধির একটা অনিবার্য দিক হল আমদানির ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি নির্ভরশীলতা। অর্থনীতি যত দ্রুত হারে বাড়বে, আমদানিও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, বস্তুত আরও দ্রুত, বাড়বে। এই আমদানির তালিকায় একেবারে গোড়ায় থাকবে পেট্রোলিয়াম। এই পণ্যটি, এবং আর কিছু পণ্যের, একটা বৈশিষ্ট্য হল অর্থনীতি যখন দ্রুত বাড়তে থাকে, এদের চাহিদাও দ্রুত বাড়ে, কিন্তু অর্থনীতি ধাক্কা খেলেও এই চাহিদা সমান হারে কমে না। আমদানি-নির্ভরশীলতার কারণে এই খাতে খরচের পরিমাণও হুহু করে বাড়ে। অন্য দিকে, ভারত যে বাজারে তার পণ্য এবং বিশেষত পরিষেবা রফতানি করে, সেই বাজার এখনও আর্থিক মন্দার প্রকোপে কাহিল। ফলে, রফতানি খাতে ভারতের আয় তেমন বাড়ছে না। আমদানির ব্যয় বাড়া আর রফতানির আয় না বাড়ার সম্মিলিত ফল একটাই— ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি। এবং, এই ঘাটতি পূরণের জন্য বিদেশি মুদ্রার (মূলত মার্কিন ডলারের) চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু, সেই চাহিদা মেটানোর মতো ডলারের জোগান কোনও পথেই সম্ভব হচ্ছে না— বিদেশ থেকেও আসছে না, আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কও তার বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার থেকে ডলার জোগাচ্ছে না। অর্থনীতির একেবারে প্রাথমিক এই চাহিদা-জোগানের অসামঞ্জস্যের গল্পই ডলারের দাম বাড়ার (অর্থাৎ, টাকার দাম কমার) কারণ।
টাকার দাম এ ভাবে কমে যাওয়ার কতগুলো মারাত্মক দিক রয়েছে।
, টাকার দাম যে ভাবে কমেছে, তাতে ভবিষ্যতে আরও কমবে বলেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের বাজারে টাকা ঢালতে ভয় পাচ্ছেন। তার কারণ, তাঁদের বিনিয়োগ এই দেশের বাজারে যতই লাভ করুক, টাকার দাম যদি আরও অনেকখানি কমে তবে সেই লাভের অঙ্ককে ডলারে পরিণত করলে লাভ আর থাকবে না। দেশের বাজার থেকে যদি বিপুল পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ বেরিয়ে যেতে থাকে, তবে একটা অর্থনীতি সম্পূর্ণ নড়ে যেতে পারে। ১৯৯০-এর দশকের শেষে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির আর্থিক সংকট এই পথেই গিয়েছিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে এখনও যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা রয়েছে। কিন্তু ব্যাঙ্কের বলা সম্ভব হচ্ছে না যে একেবারে ঠেকে গেলে ব্যাঙ্কই বিদেশি মুদ্রা জোগানোর ব্যবস্থা করবে। এই কথাটি বাজারে আরও তীব্র ভীতি তৈরি করতে পারে— এই বুঝি ভারত ডুবল! রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষে এই ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়।
, অতিচঞ্চল লগ্নি ভারত ছাড়তে আরম্ভ করলেই সম্পত্তির বাজারদরে তার প্রভাব পড়ে। ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির বড় স্তম্ভ ছিল ঋণের ওপর ভর করে চলা ভোগব্যয়। সম্পত্তির বাজারে ধস নামলে এই ভোগব্যয়ের বাজারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, আর্থিক বৃদ্ধির হারে তার প্রভাব অনিবার্য। যে দেশের অর্থনীতি এত বিচিত্র উপায়ে আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, সেই দেশে আজ না হোক কাল ধাক্কা লাগবেই।
, যে সব পণ্য আমদানি করা হয়, ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমলে সেই পণ্যগুলির দাম বাড়ে, ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। গত কয়েক মাসে যে ভাবে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বেড়েছে, তাতে এই সম্পর্কটি স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির শুধু প্রত্যক্ষই নয়, পরোক্ষ প্রভাবও আছে। প্রায় সব পণ্যের সঙ্গেই পেট্রোলিয়াম জড়িত, কারণ যে কোনও পণ্যকেই বাজারে পৌঁছে দিতে অল্পবিস্তর পরিবহণ প্রয়োজন। ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে পরিবহণ-ব্যয় বাড়লে সেই পণ্যগুলির দামও বাড়ে।
, টাকার দাম কমা মানেই যে ভারত বেশি পণ্য রফতানি করতে পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। তার দুটো কারণ।
এক, টাকার দাম কমেছে বটে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি হওয়া উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে, পণ্যটি যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছোবে, আগের তুলনায় সেটা যে ডলারের অঙ্কে কম দামে বেচা যাবে, এমনটা না-ও হতে পারে।
দুই, রফতানি শুধু টাকার দামের ওপরই নির্ভরশীল নয় যে দেশের বাজারে পণ্য বিক্রি করা হবে, তার অর্থনীতির অবস্থাও বিবেচ্য। ভারত যে দেশগুলিতে পণ্য রফতানি করে, তার অনেকগুলিই এখনও আর্থিক মন্দার প্রভাব পুরোটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
এই অবস্থায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সদ্য-নিযুক্ত গভর্নর রঘুরাম রাজন যে আর্থিক নীতি ঘোষণা করলেন, সেটা সীমিত তো বটেই, বিপজ্জনকও। তিনি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থা জোগাতে আরও এক গুচ্ছ সংস্কারের কথা ঘোষণা করলেন, যার মধ্যে প্রধানতম হল মূলধনী খাতের উদারীকরণ। অর্থাৎ, ভারতে টাকা ঢোকানো এবং বের করে নেওয়া আরও অনেক সহজ হবে। লগ্নি তুলে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিকে খেয়ালখুশি মতো নিয়ন্ত্রণ করার রাস্তাটি তিনি আরও প্রশস্ত করে দিলেন। দ্বিতীয়ত, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাটি হৃদরোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়ার মতো। পেট্রোলিয়াম বা অন্য কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির ফলে যে মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বাজারে টাকার জোগান কমিয়ে মানুষের চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাকে সামলানো যাবে না। রাজন যা করলেন, তার প্রায় অনিবার্য পরিণতি হল স্ট্যাগফ্লেশন— আর্থিক বৃদ্ধির হার থমকে থাকবে, আর মূল্যস্ফীতি চলবে।
ভারত আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে ফেরার রাস্তা আছে।
, ফাটকার উদ্দেশ্যে সোনা কেনার ওপর অনেক আগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত ছিল। চিদম্বরম বড় দেরিতে, বড় সামান্য করলেন।
, আর্থিক সংস্কারের নামে ভারতের বাজারে টাকা ঢোকানো এবং তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে বাধাহীন করার পরিবর্তে কিছু বিধিনিষেধ তৈরি করা প্রয়োজন।
, আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এই কাজটি মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদে করণীয়। তার জন্য ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির ধাঁচ পাল্টাতে হবে। কর্মসংস্থানহীন, উচ্চবিত্তের ভোগব্যয়-নির্ভর বৃদ্ধি থেকে সরে আসতে হবে সর্বজনীন ভোগব্যয়-নির্ভর বৃদ্ধির দিকে। কিন্তু, এই কাজগুলো করার একটা পূর্বশর্ত আছে। আন্তর্জাতিক ফিন্যান্সের সঙ্গে ভারত যে ভাবে জড়িয়ে আছে, সেই বাঁধনের ফাঁস আলগা করে বেরিয়ে আসতে হবে। এই কাজটা করার জন্য সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চাই।

দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.