মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং স্ট্যাটিস্টিক্স। দুর্নামটি অহেতুক নহে। পরিসংখ্যানকে আপন সুবিধা বা অভিরুচি অনুসারে কাজে লাগাইতে জানিলে অনায়াসে দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করা যায়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে পরিসংখ্যান ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহার তুলনা সুলভ নহে। তিনি রায় দিয়াছেন, অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনে ভারতে জি ডি পি তথা জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার ৮.৪ শতাংশ হইয়াছিল, বর্তমান জমানায় তাহা দাঁড়াইয়াছে ৪.৮ শতাংশ। তাঁহার প্রতিপাদ্য: বাজপেয়ী দেশের উন্নয়নে সফল হইয়াছিলেন, মনমোহন সিংহ ব্যর্থ হইয়াছেন, সুতরাং কংগ্রেসকে সরাইয়া বিজেপিকে গদিতে বসাইলেই আবার উন্নয়ন ফিরিয়া আসিবে। বাজপেয়ীর স্থলে তিনি মনে মনে আপনাকে অধিষ্ঠিত করিতেছেন, তাহা স্বাভাবিক। জিডিপি’র বৃদ্ধিকেই উন্নয়ন বলিয়া ধরিয়া লইলে অমর্ত্য সেন আপত্তি করিবেন, কিন্তু তাহাতে মোদীর কিছু যায় আসে না। কিন্তু সমস্যা অর্থনীতির নহে, সমস্যা পরিসংখ্যানের। এন ডি এ ভাল, ইউ পি এ মন্দ— এই তত্ত্বের সমর্থনে যে পরিসংখ্যান মোদী যে ভাবে নিক্ষেপ করিয়াছেন, তাহা কি যুক্তিযুক্ত?
বাজপেয়ী জমানার শেষ বছরের (২০০৩-০৪) সহিত মনমোহন জমানার শেষ বছরের (২০১৩-১৪) তুলনা করিয়া মোদী তাঁহার রায় দিয়াছেন। বাজপেয়ীর শেষ বছরে আয়বৃদ্ধি ৮.৪ শতাংশের সামান্য অধিকই ছিল। অন্য দিকে, বর্তমান বছরে সেই হার ৫ শতাংশের নীচে থাকিবে, তাহা অবধারিত। সুতরাং শেষ প্রহরের তুলনা হিসাবে মোদীর তথ্য নির্ভুল। কিন্তু শেষ উইকেটে কত রান উঠিল, নরেন্দ্র মোদীর ক্রিকেটে বুঝি তাহা দিয়াই ফলাফল নির্ধারিত হয়? অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম হিসাব কষিয়া দেখাইয়াছেন, ইউ পি এ’র শেষ বছরটি বাদ দিলে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর আর্থিক সাফল্য এন ডি এ’র তুলনায় ভাল। বস্তুত, বাজপেয়ী জমানার দুই দফায়, ছয় বছরে গড়পড়তা বার্ষিক আয়বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। ইউ পি এ’র প্রথম দফায় গড় বৃদ্ধির হার ৮.৪ শতাংশ, দ্বিতীয় দফার প্রথম চার বছরে ৭.৩ শতাংশ। প্রথমোক্ত তথ্যটি বিশেষ ভাবে বিচার্য। বাজপেয়ী জমানার শেষ বছরে— শুধুমাত্র শেষ বছরে— যে ৮.৪ শতাংশ আয়বৃদ্ধি ঘটিয়াছিল, পরবর্তী পাঁচ বছরে— মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দফায়— গড় আয়বৃদ্ধি তাহার সমান। সংখ্যার অপব্যবহার এক কথা, আর সংখ্যাকে দিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলাইবার চেষ্টা অন্য কথা। মোদী দ্বিতীয় কাজটি করিতেছেন।
মনমোহন সিংহের দ্বিতীয় দফার অ-শাসন অবশ্যই লজ্জাকর। অর্থনীতিকে তাহার দায় ভোগ করিতে হইতেছে, তাহাও অনস্বীকার্য। বিরোধী দল হিসাবে বিজেপি তাঁহার ব্যর্থতার প্রবল সমালোচনা করিবে, ইহাও প্রত্যাশিত। কিন্তু তথ্য-পরিসংখ্যান ব্যবহার করিয়া সম্যক আলোচনার একটি প্রাথমিক শর্ত আছে। পরিসংখ্যানের ব্যবহার জানিতে হয়, শিখিতে হয়। বিজেপির নেতারা সম্ভবত এই বিষয়ে যথেষ্ট পারদর্শী নহেন। অন্তত যশবন্ত সিন্হা (ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী) বা রবিশংকর প্রসাদ যে ভাবে মোদীর বিচিত্র তুলনাকে কলকণ্ঠে সমর্থন করিয়াছেন, তাহাতে তেমন সংশয় স্বাভাবিক। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হইতে চাহেন। তাঁহার পক্ষে সেই বিদ্যা জানা এবং শেখা বিশেষ আবশ্যক। সে জন্য এই সতীর্থদের অপেক্ষা ভাল শিক্ষক খুঁজিয়া লওয়াই বিচক্ষণের কাজ হইবে। যথা, জগদীশ ভগবতী। |