রঘুরামের নতুন সূচকে মমতা ক্ষুব্ধ, কপাল খুলবে নীতীশের
কটা রিপোর্ট, যার পরতে পরতে রাজনৈতিক সমীকরণ আর বিতর্কের ছায়া। আর সেই রিপোর্ট ঘিরে কারও স্বস্তি, কারও অস্বস্তি কারও বা ক্ষোভ।
রাজ্যগুলির অনগ্রসরতার নতুন মাপকাঠি তৈরি করে তার ভিত্তিতে উন্নয়নের জন্য অর্থ সাহায্য দেওয়ার নতুন সূত্র তৈরির জন্য গত মে মাসে রঘুরাম রাজনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। সেই রিপোর্ট ৫ সেপ্টেম্বর জমা পড়ে এবং আজ সেটি প্রকাশিত হয়। ওই রিপোর্টকে ভিত্তি করেই লোকসভা ভোটের আগে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের সম্ভাবনা উস্কে দিয়ে ওড়িশা এবং বিহারকে আরও বেশি কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্য দেওয়ার পথে হাঁটতে চলেছে মনমোহন সিংহের সরকার। কারণ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, সবথেকে অনুন্নত রাজ্যের তালিকায় এই দু’টি রাজ্যের স্থান যথাক্রমে এক এবং দুই নম্বরে। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত রাজ্যের তালিকায়। ফলে কমিটির সুপারিশ মানলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রীয় সাহায্যের পরিমাণ কমবে। রাজন-কমিটির এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বিমাতৃসুলভ মনোভাব থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে বাংলাকে বঞ্চনা করছে।
বিতর্কের শেষ এখানেই নয়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে তাঁর রাজ্য প্রথম সারিতে আছে, এই দাবি করে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে দেশের সামনে ‘গুজরাত মডেল’ তুলে ধরছেন, তখন রাজন কমিটির রিপোর্ট বলছে, উন্নয়নের হিসেবে গুজরাত অনেকটাই পিছিয়ে। এমনকী ত্রিপুরা, সিকিম, হিমাচল প্রদেশের থেকেও পিছিয়ে মোদীর রাজ্য!
বিহারের জন্য বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দাবি করে দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রের কাছে দাবি জানাচ্ছিলেন নীতীশ কুমার। একই দাবি ছিল ওড়িশার নবীন পট্টনায়কেরও। আবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ অর্থসাহায্য চেয়ে সরব হয়েছিলেন মমতা। এ নিয়ে রাজনৈতিক তরজার পরিপ্রেক্ষিতেই মে মাসে রঘুরাম রাজনের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি তৈরি হয়। সেই কমিটির রিপোর্টে দেশের ২৮টি রাজ্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করার সুপারিশ করা হয়েছে। সবথেকে অনুন্নত, অপেক্ষাকৃত কম উন্নত এবং তুলনামূলক ভাবে উন্নত। সুপারিশ মানা হলে রাজ্যগুলির যোজনা বরাদ্দে এবং কেন্দ্রীয় অনুদানে চলা প্রকল্পে কেন্দ্র যে অর্থ দেয়, তার হিসেবনিকেশ পাল্টে যাবে। বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি সবথেকে অনুন্নত রাজ্যের তালিকায় পড়েছে। ফলে তারা আগের তুলনায় বেশি অর্থ পাবে। অন্য দিকে অপেক্ষাকৃত কম অনুন্নত রাজ্যের তালিকায় থাকা গুজরাত বা পশ্চিমবঙ্গের বরাদ্দ কিছুটা কমবে।
মাল্টি ডাইমেনশনাল ইনডেক্স
আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়ার অনেক দিক থাকতে পারে। কেউ ন্যূনতম পুষ্টি ও স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। কোথাও প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নেই। কোনও ক্ষেত্রে আবার জীবনযাত্রার মান তলানিতে। অর্থাৎ জ্বালানি, পানীয় জল, শৌচাগার বা বিদ্যুতের সংযোগ সেখানে যথেষ্ট নয়। তাই এই সমস্ত কিছুকে এক সঙ্গে বিচার না-করলে, আর্থিক ভাবে কোনও দেশ, রাজ্য বা অঞ্চল তুলনামূলক ভাবে কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে, তা বোঝা অসম্ভব। এ কথা মাথায় রেখেই এই সব কিছু নিয়ে একটি সূচক তৈরি করে রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন পর্ষদ (ইউএনডিপি)। প্রথম ব্যবহার ২০১০ সালের বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্টে। এতে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বা দারিদ্র বিচার করা হয় বিভিন্ন দিক (মাল্টি ডাইমেনশন) থেকে।

আর্থিক স্বাস্থ্য অনুযায়ী ভারতের কোন রাজ্য কেন্দ্রের কাছ থেকে কতটা অনুদান পাবে, তা ঠিক করতে বৃহস্পতিবার এই সূচক ব্যবহারেরই সুপারিশ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের নেতৃত্বাধীন কমিটি।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এই সমীকরণ তৈরির পিছনে কি রাজনীতি কাজ করেছে? বিহার ও ওড়িশার দুই এনডিএ-ত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ এবং নবীনকে কংগ্রেস প্রবল ভাবে পাশে পেতে আগ্রহী। উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম সিংহ যাদবকেও সঙ্গে রাখতে চায় তারা। সবথেকে অনুন্নত রাজ্য হিসেবে যে দশটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে বাকিগুলি হল মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ, অসম, মেঘালয় ও রাজস্থান। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় ও রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। বাকি রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসই মূল শাসক দল। রাজনের সুপারিশ মানলে এই রাজ্যগুলি উপকৃত হবে এবং ভোটবাক্সে এর ফায়দা তোলার সুযোগ পাবে কংগ্রেস। উল্টো দিকে অপেক্ষাকৃত কম অনুন্নত ১১টি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সব রাজ্যগুলির যোজনা আয়তনে কেন্দ্রীয় সাহায্য ও কেন্দ্রীয় অনুদানে চলা প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্র মোট যে অর্থ বরাদ্দ করে, তার ৬.৯৩% পায় পশ্চিমবঙ্গ। নতুন সুপারিশ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ পাবে ৫.৫০%। যেখানে বিহারের ভাগ ৭.৪২ থেকে বেড়ে হবে ১২.০৪%। ওড়িশার ভাগ ৪.৬২ থেকে ৬.৫৩%-এ পৌঁছবে। আর উত্তরপ্রদেশ ১০.০৯%-এর বদলে পাবে ১৬.৪১%।
আজ পটনায় নীতীশ রাজন-কমিটির সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছেন। অন্য দিকে কেন্দ্রের দিকে বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রের থেকে সাহায্য পাবে না কেন? বিশেষ করে যেখানে নতুন সরকার বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। পশ্চিমবঙ্গকে কেন বঞ্চিত করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজন-কমিটির রিপোর্টে খুশি নন নবীন পট্টনায়কও।
যা নিয়ে এত বিতর্ক, সেই রঘুরাম রাজন কমিটির সুপারিশ কী?
মাথাপিছু ব্যয়, দারিদ্রের হারের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের মাপকাঠির ভিত্তিতে একটি নতুন ‘বহুমুখী সূচক’ বা মাল্টি ডাইমেনশনাল ইনডেক্স (এমডিআই) তৈরি করেছে রাজন কমিটি। এই সূচক অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্যকে অনুন্নয়নের ভিত্তিতে ০ থেকে ১-র মধ্যে নম্বর দেওয়া হয়েছে। ০.৬-এর থেকে যারা বেশি নম্বর পেয়েছে, তারা রয়েছে সবথেকে অনুন্নত রাজ্যের তালিকায়। ০.৪ থেকে ০.৬-এর মধ্যে নম্বর পাওয়া রাজ্যগুলিকে অপেক্ষাকৃত কম অনুন্নত রাজ্যের তালিকায় ফেলা হয়েছে। ০.৪-এর থেকেও কম নম্বর পাওয়া রাজ্যগুলি তুলনামূলক ভাবে উন্নত রাজ্যের তালিকায় থাকছে। আর সেই হিসেবে তুলনামূলক উন্নত রাজ্যের তালিকায় রয়েছে গোয়া, কেরল, তামিলনাড়ু, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, উত্তরখণ্ড ও হরিয়ানাএই সাতটি রাজ্য। কমিটির সুপারিশ, মোট অর্থ বরাদ্দের ০.৩ শতাংশ সব রাজ্যগুলিকে সমান ভাবে ভাগ করে দেওয়া হোক। এতে ব্যয় হবে ৮.৪ শতাংশ। বাকি ৯১.৬ শতাংশ রাজ্যগুলির উন্নয়নের চাহিদা এবং উন্নয়নের কাজের ভিত্তিতে ভাগ করে দেওয়া হোক। তার জন্য কাজে লাগানো হোক ‘বহুমুখী সূচক’-কে। রাজনের বক্তব্য, সময়ের সঙ্গে রাজ্যগুলির উন্নয়নের চাহিদা বাড়বে, কমবে। তাই প্রতি পাঁচ বছ অন্তর এই সূচক সংশোধন করা হোক। রাজন কমিটির সুপারিশ, বিশেষ শ্রেণিভুক্ত রাজ্যের সংজ্ঞা মুছে দিয়ে অনুন্নয়নের ভিত্তিতেই অর্থ বরাদ্দ হোক।
রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হলেও এর পিছনে কোনও পাইয়ে দেওয়া বা বঞ্চনার রাজনীতি রয়েছে বলে মানতে নারাজ অর্থ মন্ত্রক। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের ব্যাখ্যা, রাজন-কমিটির সুপারিশ মানা হলেও চলতি অর্থবর্ষে তার কোনও প্রভাব পড়ছে না। আগামী অর্থবর্ষ থেকেই নতুন সমীকরণ অনুযায়ী অর্থসাহায্য বণ্টন করা হবে। কিন্তু টাকার অঙ্কে সেখানেও বিশেষ হেরফের হবে না বলেই দাবি মন্ত্রক কর্তাদের।
তাঁদের যুক্তি, গ্যাডগিল-মুখার্জি সূত্র মেনেই রাজ্যগুলিকে মোট রাজস্ব আয়ের ভাগ দেওয়া হয়। সেই সূত্রে কোনও বদল আসছে না। অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী যে অর্থ সাহায্য রাজ্যগুলির কাছে যায়, নতুন অর্থ কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হওয়া পর্যন্ত তাতেও কোনও বদল আসছে না। সর্বোপরি চতুর্দশ অর্থ কমিশনকে পশ্চিমবঙ্গের মতো ঋণগ্রস্ত রাজ্যগুলির সমস্যা বিশেষ ভাবে খতিয়ে দেখে সমাধানের পথ দেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর পরে বাকি থাকে উন্নয়নের চাহিদার ভিত্তিতে দেওয়া অর্থ। সেখানে একমাত্র অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন তহবিল এবং ছোটখাটো কিছু প্রকল্প থেকে অর্থ যায়। তার বরাদ্দের হিসেবনিকেশেই বদল আসবে। কারণ আদিবাসী উন্নয়ন বা সীমান্তবর্তী এলাকা উন্নয়ন খাতে দেওয়া অর্থেও কোনও বদল আসবে না। ফলে শতাংশের হিসেবের মতো টাকার অঙ্কেও রাজ্যের ভাগে বিশেষ বদল হবে না বলে দাবি মন্ত্রক কর্তাদের।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.