|
|
|
|
জম্মুতে হত ১০, গোয়েন্দা সমন্বয় নিয়ে প্রশ্ন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি ও শ্রীনগর |
সাতসকালে জম্মুর থানা এবং সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হানার ঘটনায় ফের প্রশ্নের মুখে পড়ল গোয়েন্দাদের বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়। জম্মুর হিরানগর থানা এবং সেনাবাহিনীর সাম্বা বিগ্রেড অফিসে এই জোড়া হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল-সহ অন্তত ১০ জন। সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, সংঘর্ষে তিন জঙ্গিও নিহত হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকের ৭২ ঘণ্টা আগে এমন ঘটনায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। গোটা ঘটনাটি নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন তিনি। এবং ঘটনাটি কী ভাবে ঘটল, তা তদন্ত করে দেখতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে নির্দেশও দিয়েছেন।
বিভিন্ন গোয়েন্দা এজেন্সির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে জঙ্গি হানার ঘটনা এই প্রথম নয়। ২৬/১১-র পরেও এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এমনকী, কার্গিল যুদ্ধের পরেও গোয়েন্দা এজেন্সি এবং সেনা গোয়েন্দাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। পরে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ তৈরি করে সব গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টাও হয়েছে। জম্মুতে এ দিনের জঙ্গি হানার পরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তার পরেও সমন্বয়ে খামতি থাকে কী ভাবে? বিশেষ করে খুব শীঘ্রই যেখানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক হতে চলেছে। জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা অবশ্য বলেছেন, “দুই প্রধানমন্ত্রীর উচিত আলোচনা প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া। এই সমস্যা সমাধানের এটাই একমাত্র উপায়।” প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের একটি সূত্রে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার জম্মুর ঘটনাতে তেমন কোনও গাফিলতি হয়েছে কি না, সেটাই এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা হচ্ছে। |
|
জঙ্গিহানায় প্রাণ হারানো যুবকের দেহের পাশে এক পুলিশ অফিসার। বৃহস্পতিবার হিরানগরে। ছবি: রয়টার্স। |
কী হয়েছে এ দিন?
জম্মুর সেনা মুখপাত্র শিবনারায়ণ আচার্য জানান, এ দিন সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ একটি সব্জি বোঝাই টেম্পোয় চড়ে সামরিক পোশাক পরা তিন জঙ্গি হিরানগর থানায় ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন চার পুলিশকর্মী। মারা যান হেফাজতে থাকা আরও এক ব্যক্তি। এর পরেই থানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের চালককে ভয় দেখিয়ে তাতে চেপে বসে জঙ্গিরা। ট্রাকের খালাসি সঙ্গে যেতে না চাইলে তাঁকেও গুলি করা হয়। সেই ট্রাক নিয়ে এর পরে সাম্বা সেনা ছাউনির দিকে রওনা হয় জঙ্গিরা।
সেনা সূত্রের খবর, ব্রিগেড অফিসের একটু আগে ট্রাক থেকে নেমে প্রথমে মূল দরজায় সামনে দাঁড়ানো সেন্ট্রিকে গুলি করে জঙ্গিরা। তার পরে সোজা অফিসার্স মেসে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে তারা। তাতে মারা যান ১৬ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল বিক্রমজিৎ সিংহ-সহ তিন জন সেনা জওয়ান। আহত হয়েছেন ওই রেজিমেন্টের কম্যান্ডিং অফিসার-সহ আরও তিন জন। তাঁদের পাঠানকোট সেনা হাসপাতালে আইসিইউ-এ ভর্তি করানো হয়েছে।
হামলার খবর পেয়েই অন্য একটি ছাউনি থেকে শিখ রেজিমেন্ট ও অসম রেজিমেন্টের দু’টি দলকে ঘটনাস্থলে
পাঠানো হয়। ছাউনির উপরে চক্কর দেওয়া শুরু করে সেনা হেলিকপ্টারও। শুরু হয় দু’পক্ষের গুলির লড়াই। সেনা সূত্রের খবর, বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ তিন জঙ্গির মৃত্যুর পর শেষ হয় সেনা-অপারেশন। পুলিশ ও সেনাকর্তারা জানান, শাহোদা ব্রিগেড নামে স্থানীয় একটি জঙ্গি সংগঠন দায় স্বীকার করলেও এটি লস্কর-ই-তইবার একটি শাখা সংগঠন বলেই গোয়েন্দারা মনে করছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও লস্করেরই হাত দেখছে।
গোয়েন্দা সূত্রে বলা হয়েছে, পাক অধিকৃত কাশ্মীর থেকে জঙ্গি দলটি বুধবার রাতে কঠুয়ার কাছাকাছি একটি সীমান্ত দিয়ে এ দেশে ঢুকেছিল। ওই সীমান্ত এলাকায় একটি নালা রয়েছে। সম্ভবত সেটি দিয়েই জঙ্গিরা অনুপ্রবেশ করেছিল। সেনাবাহিনীর একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ রুখতে বিশেষ ধরনের কাঁটাতারের ব্যবস্থা রয়েছে। তার ফলে অনুপ্রবেশ প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে কী ভাবে ওই জঙ্গিরা ঢুকে পড়ল, তা নিয়ে কঠুয়া এলাকার দায়িত্বে থাকা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। ওমর আবদুল্লা বলেছেন, “এই এলাকায় সম্প্রতি কিছু অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে ঠিকই, কিন্তু জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার দৃষ্টান্ত এখানে বিশেষ নেই।” |
|
প্রশ্ন উঠেছে, অনুপ্রবেশ কম হয়, এই কারণেই কি এই এলাকায় সেনা ও পুলিশের মনোভাবে কোনও আত্মতুষ্টির জায়গা তৈরি হয়েছিল? সেনার একটি সূত্রের মতে, জম্মু এলাকায় জঙ্গিদের নির্মূল করা গিয়েছে বলে বাহিনীর একাংশের দাবি ছিল। ওই এলাকায় পুলিশেরও গা-ছাড়া মনোভাব তৈরি হয়েছিল। সেনা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের গোয়েন্দাদের কাজেও আত্মতুষ্টির ছাপ এসেছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে এ বারে।
যে কারণেই হোক, অনুপ্রবেশ যে বেড়েছে, তার প্রমাণ মিলেছে সাম্প্রতিক এক তল্লাশি অভিযানে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, গত মঙ্গলবার কুপওয়ারা এলাকায় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের যৌথ তল্লাশি অভিযানে ২টি একে-৫৬ রাইফেল, ২টি পিস্তল, ৫টি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী গ্রেনেড, ২টি রেডিও সেট-সহ নানা যন্ত্রপাতি মিলেছিল। গোয়েন্দাদের ব্যাখ্যা ছিল, ওই এলাকায় পাক সেনাবাহিনীর বিশেষ দল ‘বর্ডার অ্যাকশন টিম’ সক্রিয় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সীমান্তে কোনও হামলা হলেও হতে পারে। এ দিনও যেমন সংঘর্ষ বিরতির চুক্তি ভেঙে রাজৌরি সেক্টরে গোলাগুলি চালিয়েছে পাক বাহিনী। কিন্তু কঠুয়া সীমান্ত দিয়ে যে জঙ্গিরা ঢুকতে পারে, এমন কোনও সম্ভাবনার কথা মাথাতেই আসেনি গোয়েন্দাদের।
এই হামলার পিছনে অবশ্য কিছুটা অভিনবত্বও দেখছে স্বরাষ্ট মন্ত্রকের একাংশ। তাঁরা বলছেন, ২০০৮ সালে সাম্বায় সাধারণ বাসযাত্রীদের উপরে জঙ্গি হামলা হলেও কোনও নিরাপত্তা বাহিনীর ছাউনি তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। কিন্তু এ দিন থানা ও সেনা ছাউনিতে যে ভাবে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে ওই তিন জঙ্গি আত্মঘাতী বা ফিঁদায়ে বাহিনীর সদস্য বলেই মনে করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। পাশাপাশি গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ১৬ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট ওই এলাকায় তুলনামূলক কমজোরি। সে ক্ষেত্রে সহজ শিকার হিসেবেই তাদের বেছে নিয়েছে জঙ্গিরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, “ওই তিন জন হামলার আগে আশপাশে নজরদারি চালায়নি। তবে ওই এলাকায় ওই জঙ্গিদের নিজস্ব গোয়েন্দাবাহিনী কাজ করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।” |
|
|
|
|
|
|