বন্ধুকে উপহার দেবেন বলে একটি নামী পোশাকের বিপণি থেকে পাঞ্জাবি কিনে মহা বিড়ম্বনায় পড়ে গেলেন উপমা। গড়িয়াহাটের ওই দোকানে পাঞ্জাবি দেওয়া হয়েছে একটি মোটা কাগজের থলেতে। কিন্তু বাইরে যে তখন অঝোর বৃষ্টি। বাধ্য হয়ে ক্যাশ কাউন্টারে থাকা যুবকের কাছে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ চাইলেন তিনি। তাঁকে সবিনয় জানিয়ে দেওয়া হল, চাইলে আরও দশটি কাগজের থলে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্লাস্টিকের ব্যাগ? “সরি ম্যাডাম।”
এই ঘটনা ব্যতিক্রম। শহরের আসল ছবি নয়। ওই বিপণির মতো কলকাতার কয়েকটি মাত্র দোকান প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার পুরোপুরি বর্জন করেছে। কিন্তু কলকাতার আনাচ-কানাচে এখনও দেদার ব্যবহার হচ্ছে নানা ধরনের প্লাস্টিক ব্যাগ। অথচ ৪০ মাইক্রোনের কম মোটা এবং ১৬ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি আকারের চেয়ে ছোট প্লাস্টিক ব্যাগ রাজ্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ! বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই মান ও আকারের প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলে তা পুনর্ব্যবহার করা যায় না। উল্টে পরিবেশ নষ্ট করে।
পরিবেশকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়েই মাছের বাজার থেকে মণিহারি-সুগন্ধির দোকান, ওষুধের দোকান থেকে মুদিখানা সর্বত্র নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগের রমরমা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহারের কারণেই বহু জায়গায় নিকাশি নালা আটকে যাচ্ছে। শহর জুড়ে তৈরি হচ্ছে আবর্জনার স্তূপ। নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ গিলে ফেলায় গৃহপালিত পশুর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। অথচ নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার পুরোপুরি বর্জন করা গেলে বর্ষায় কলকাতার রাস্তা জল-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে বলে মনে করেন পরিবেশবিদেরা।
কিন্তু নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করলে কি শাস্তি নেই? |
নিউ মার্কেট চত্বরে রমরমিয়ে চলছে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য। |
প্রশাসন সূত্রের খবর, নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ যে দোকানদার দেবেন, তাঁকে ৫০০ টাকা এবং যে ব্যবহার করবেন, তাঁকে ৫০ টাকা জরিমানা করার ক্ষমতা রয়েছে কলকাতা পুরসভার হাতে। ২০০৮ সালে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ওই ক্ষমতা দেয় পুরসভাকে। তখন পাড়ার মুদি দোকান থেকে শপিং মলের দোকান, সকলেই নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। শহরের কিছু মিষ্টির দোকানেও লেখা হয়েছিল সতর্কবার্তা, ‘প্লাস্টিকের ব্যাগ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না।’ মিষ্টির পরিমাণ কম হলে তখন বাক্সের মধ্যে মোটা কাগজ বসিয়ে ক্রেতার হাতে দেওয়া হত। আর বেশি পরিমাণ মিষ্টি হলে তা দেওয়া হত ৪০ মাইক্রোনের প্লাস্টিক ব্যাগে।
সেই নিয়ন্ত্রণ এখন উধাও। শহর তথা রাজ্যের ছোট-বড় দোকান-বাজারে স্বমহিমায় ফিরে এসেছে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগ। প্রশাসন সূত্রে খবর, দোকানে-বাজারে হানা দিয়ে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ আটক ও জরিমানা করার জন্য কলকাতা পুরসভা কিংবা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অভিযান ২০১০ থেকে এক রকম বন্ধ। পর্ষদের ‘স্টেট প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট কমিটি’র বৈঠকও ২০১১-র ফেব্রুয়ারির পরে আর হয়নি বললেই চলে।
পর্ষদের অবশ্য দাবি, সম্প্রতি পুরকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন বাজার পরিদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু ধরপাকড়, জরিমানা না করলে যে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না, পর্ষদ-কর্তারাও তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁদের মতে, বাজার-দোকান করতে গেলে সঙ্গে ব্যাগ নিয়ে যান না এক শ্রেণির ক্রেতা। ক্রেতা হারানোর ভয়ে দোকানদার-ব্যবসায়ীরাও বিনা বাক্যব্যয়ে সস্তার নিষিদ্ধ ক্যারিব্যাগ দিয়ে দেন তাঁদের হাতে। তবে প্রশাসনের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, যে কাজ রায়গঞ্জ, বহরমপুর, কল্যাণী পুরসভা করে দেখাতে পারে, এমনকী কলকাতা-লাগোয়া বাঙুর এলাকাও পারে, তা কেন এই শহর এবং তার পুরসভা পারে না? |
জল-নিকাশি পাম্পের পাইপের মুখ আটকে গিয়েছে প্লাস্টিকে। —ফাইল চিত্র। |
সমস্যাটা যে গভীর, তা মেনে নিয়েছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার। তাঁর কথায়, “এক বা দু’দিনের প্রচারে ৪০ মাইক্রোনের নীচের প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক প্রচার।” তিনি বলেন, “লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট বাজার, কোলে মার্কেটে ঘুরে বুঝেছি ৪০ মাইক্রোনের নীচের পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করতে গেলে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। সঙ্গে চাই কড়া শাস্তি।” পুরসভার পরিবেশ বিভাগের সদ্য প্রাক্তন মেয়র পারিষদ সঞ্চিতা মণ্ডল বলেন, “মাঝেমধ্যে অভিযান হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ‘স্পট ফাইন’ করা হয়েছে। ক্রেতাদেরও সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু অভিযান ধারাবাহিক হয়নি বলেই ৪০ মাইক্রোনের কম প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা যায়নি।” তাঁর অভিযোগ, পুরসভার নিজস্ব বাজারগুলিতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বেসরকারি বাজার-দোকানে অবাধে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে।
নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহারে কী শাস্তি? দেবাশিসবাবু জানান, ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বা পুনর্নবীকরণ সময়ে ৪০ মাইক্রোনের কম প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা যাবে না বলে শর্ত দেওয়া যেতে পারে। তা পূরণ না হলে কী শাস্তি হবে, তা-ও লাইসেন্সে থাকবে। এখন কি লাইসেন্সে এমন শাস্তির ব্যবস্থা আছে? ট্রেড লাইসেন্স বিভাগের এক অফিসার জানান, লাইসেন্সে শুধু বলা থাকে ৪০ মাইক্রোনের কম প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। শাস্তির কথা থাকে না। কেন? ওই অফিসারের বক্তব্য, আগের পুর-প্রশাসন লাইসেন্সে শাস্তির বিধান রাখতে দেয়নি। তাই ওই নিয়ে কিছু বলা নেই।
অতএব, পরিবেশ দূষিত হলেও কলকাতায় নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে রাশ টানার কোনও সম্ভাবনা এখনই দেখা যাচ্ছে না। |