কলকাতার জল সরবরাহ ও নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কারে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি) থেকে ৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এডিবি-র অন্যতম শর্ত হল, শহরে জলকর বসাতে হবে। যদিও কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এমন কোনও শর্তের কথা জানি না। আমরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোনও জলকর নেব না।”
তা হলে কি ওই ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে? এডিবি জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির কথা তাদের জানা। ওই প্রকল্প সম্পূর্ণ হতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগবে। ধাপে ধাপে জলকর বসানোর ব্যবস্থা করলেই হবে। মেয়র শোভনবাবুর কথায়, “আমরা তো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জলকর নিই। সেখান থেকে পাওয়া করের টাকায় ভর্তুকি মেটানো সম্ভব হয়। তাই সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে জলকর বসানোর প্রয়োজন নেই।”
তবে কলকাতার মেয়র যা-ই বলুন না কেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক এ-ও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে শহরের জল সরবরাহ ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ করে তাকে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে এ বার কর সংগ্রহের ব্যবস্থাকে আরও সুংসহত করতে হবে কলকাতা পুরসভাকে। তাঁদের হিসেব মতো শহরে আরও ৪০ হাজার জলের মিটার বসাতে হবে পুর-প্রশাসনকে।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, এডিবি-র ওই ঋণের টাকায় কলকাতায় যেমন জল সরবরাহ ব্যবস্থার নতুন পরিকাঠামো গড়া হবে, তেমনই প্রথম পর্যায়ে দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিম শহরতলি এলাকায় বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, নিকাশি পাম্প, নতুন পাইপ বসানো-সহ সংস্কারের কাজ হবে।
এ ব্যাপারে এডিবি-র নগরোন্নয়ন ও জল বিভাগের দক্ষিণ এশিয়ার ডিরেক্টর ফেই ইউ বলেন, “কলকাতা সপ্তম বৃহত্তম শহর। অথচ শহরের সব নাগরিকদের মৌলিক পরিষেবাগুলি পাইয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।” এ বার যে সব এলাকায় সংস্কারের কাজ পিছিয়ে আছে, সেখানেই নজর দেওয়া হবে। তাঁর কথায়, “শহরতলির উন্নয়নের উপরে এখনই জোর না দিলে ভবিষ্যতে আরও বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি হতে পারে।”
এডিবি-র তরফে জানানো হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে ১০ কোটি ডলার ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে কলকাতা পুরসভাকে। ওই টাকায় টালা ও গার্ডেনরিচের জলের পাম্প দু’টির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হবে। মূল লক্ষ্য হবে আগামী ১০ বছরের মধ্যে জলের উৎপাদন ক্ষমতা ধাপে ধাপে বাড়িয়ে দৈনিক ১৪৭.৮ কোটি লিটারে পৌঁছে দেওয়া।
এডিবি-র সমীক্ষা অনুযায়ী, শহরের জল সরবরাহ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা খুবই ত্রুটিপূর্ণ। তার সংস্কারে খুব বেশি টাকা ব্যয় করা হয়নি। তাই ৫৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের বিভিন্ন ছিদ্রপথে প্রতিদিনই ৩০ কোটি লিটার জল নষ্ট হচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, কলকাতা পুরসভাকে ঋণ দেওয়ার অন্যতম লক্ষ্য হল জলের এই অপচয় বন্ধ করা। উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি জলের অপচয় বন্ধ করা গেলে শহর ও শহরতলি এলাকায় ২৪ ঘণ্টা জল সরবরাহ সুনিশ্চিত করা যেতে পারে বলে মনে করছেন এডিবি কর্তারা।
এরই পাশাপাশি দ্বিতীয় দফায় এডিবি-র ঋণের টাকায় দক্ষিণ শহরতলির নিকাশি ব্যবস্থার আমুল সংস্কারের একটি নকশা তৈরি হয়েছে। সেখানে ২৩০০টি নতুন নিকাশি নালা তৈরি হবে। তা ছাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম শহরতলিতে মোট তিনটি বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি করবে পুরসভা। এডিবি সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ নিকাশি পাইপ বসানো হবে।
এর আগে কলকাতা পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় শহরের নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কারে ইতিমধ্যেই দু’দফায় ৩৩ কোটি ডলার বা প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এডিবি। কিন্তু এর পরেও কলকাতা পুরসভা ও রাজ্যের দাবি ছিল, যাতে শহরের জল ও নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কারে আরও ঋণ দেয় এডিবি। সেজন্য কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছিল রাজ্যের তরফে। অর্থ মন্ত্রকের মধ্যস্থতায় নতুন করে আরও ৪০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে এ বার সম্মত হল এডিবি।
মেয়র শোভনবাবু বলেন, “অনেক কাজ বাকি আছে। আশা করছি এডিবি-র টাকায় আগামী বছরের গোড়াতেই কাজ শুরু করব।” |