ঘরে-বাইরে চাপ অব্যাহত থাকায় আরও একবার সুর নরম করে জিটিএ চালানোর স্পষ্ট বার্তা দিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ।
সম্প্রতি দিল্লিতে একটি আলোচনা সভায় মোর্চার মুখপাত্র হরকাবাহাদুর ছেত্রী জানিয়েছিলেন, এখনই তাঁরা জিটিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন না। বুধবার কালিম্পঙের একটি স্থানীয় চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে খোদ গুরুঙ্গও জানিয়ে দিয়েছেন, গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন চলবে তবে আপাতত জিটিএ ছাড়ার কথা ভাবা হচ্ছে না। তাঁর বক্তব্য, “জিটিএ ছেড়ে দেওয়ার জন্য গোর্খাল্যান্ড জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির (জ্যাক) শরিকরা চাপ বাড়াচ্ছেন। আমরা মানছি জিটিএ ব্যর্থ হয়েছে। তবু জিটিএ ছাড়লেই রাতারাতি সব হয়ে যাবে এটা ভাবা ঠিক নয়।” তাঁর বক্তব্য, “গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলনের ক্ষেত্রে জিটিএ কোনও বাধা নয়। কারণ, জিটিএ গঠনের চুক্তিতে লেখা রয়েছে, মোর্চা গোর্খাল্যান্ডের দাবি ছাড়ছে না।”
মোর্চার অন্দরের খবর, তাদের বেশ কয়েকজন কর্মীকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাই জিটিএ ছেড়ে পাহাড়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যেতে চায় না মোর্চা। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জিটিএ-র নতুন ‘চিফ এক্সিকিউটিভ’ নির্বাচনে মোর্চার সদস্যেরা যোগ দেবেন। মোর্চার অন্দরের খবর, সব ঠিকঠাক থাকলে গুরুঙ্গের নামই ফের ওই পদের জন্য প্রস্তাবও করা হবে। যদিও গুরুঙ্গ এখনও তাতে রাজি হননি। বরং জিটিএ-র ডেপুটি টিফ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল রমেশ আলেকে সেই পদে বসানোর পক্ষে মত দিয়েছেন গুরুঙ্গ-ঘনিষ্ঠদের অনেকেই। তবে মোর্চা সূত্রেই জানা গিয়েছে, আলেও ওই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নন।
তেলঙ্গানা গঠনের পরে পাহাড়ে যে লাগাতার বন্ধ শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত রাজ্যের কড়া মনোভাব ও পাহাড়বাসীর চাপে তুলে নিতে বাধ্য হন গুরুঙ্গ। তবে ২০ অক্টোবরের পরে ফের পাহাড় অচল করার ডাক দিয়েছেন গুরুঙ্গ। এর মধ্যে পাহাড়ের পড়ুয়াদের ‘মিশন গোর্খাল্যান্ড’-এ সামিল করার ফতোয়াও দেন তিনি। কিন্তু পাহাড়ের অভিভাবক ও স্কুলগুলির একাংশের আপত্তিতে মোর্চা এখনও স্কুলে গিয়ে প্রচারের কর্মসূচি শুরু করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, জ্যাক-এর শরিক সিপিআরএম সহ কয়েকটি দল বন্ধ, স্কুলে প্রচারের সিদ্ধান্তও মেনে নিতে পারেননি।
বরং তাঁরা জিটিএ ছাড়ার জন্য মোর্চার উপরে চাপ বাড়িয়েছিলেন। যেমন জ্যাক-এর মুখপাত্র তথা কার্যকরী সভাপতি এনোস দাস প্রধান বলেছেন, “মোর্চা জিটিএ ছেড়ে পুরোপুরি গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন করবে, এমন আশ্বাসের উপরেই কমিটি গঠন হয়। সে জন্য আমরা গুরুঙ্গকে জ্যাকের সভাপতি পদে বসিয়েছি। আমরা জিটিএ বৈঠকের উপরে নজর রাখছি। মোর্চা ওই বৈঠকে কী করে সেটা দেখেই পরবর্তী পদক্ষেপ করব।” সিপিআরএমের মুখপাত্র তথা জ্যাকের কার্যকরী কমিটির নেতা গোবিন্দ ছেত্রীও একই ভাবে জিটিএ বৈঠকে মোর্চা কী ভূমিকা নেয় সে দিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
তাই মোর্চা সভাপতির অস্বস্তি আরও বেড়েছে। আগামী দিনে তাঁকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে আঁচ করে গুরুঙ্গ এদিনের সাক্ষাৎকারে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি জ্যাক-এর সভাপতি পদ থেকে সরতে চান। এমনকী, তিনি জ্যাক-এর দলগুলির সমালোচনাও করেছেন। তাঁর যুক্তি, “আমরা আলাদা রাজ্যের দাবিতে যে আন্দোলন করতে চাইছি, তার রূপরেখার সঙ্গে জ্যাকের অনেকে একমত নন। সে জন্য আমি জ্যাকের সভাপতি পদ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তবে তিনি না থাকলেও মোর্চার অন্য নেতারা কমিটিতে থাকবেন। এনোস দাস প্রধান কিংবা গোবিন্দ ছেত্রীরা অবশ্য জানিয়েছেন, জ্যাক-এর সভাপতি পদ থেকে গুরুঙ্গের ইস্তফা দেওয়ার ব্যাপারে কোনও চিঠি কিংবা অনুরোধ তাঁদের কাছে পৌঁছয়নি।
তবে মোর্চা নেতাদের একাংশের আশঙ্কা, জিটিএ ছাড়া নিয়ে ‘জ্যাক’ শরিকদের কথায় বেশি গুরুত্ব দিতে গেলে দলের মধ্যে ভাঙন ধরতে পারে। কারণ, মোর্চার অন্দরের খবর, ইতিমধ্যেই পাহাড়ের নানা এলাকায় মোর্চা নেতা-কর্মীরা কম সংখ্যায় হলেও ধীরে ধীরে তৃণমূলের দিকে ঝুঁকছেন। মোর্চা প্রভাবিত জনমুক্তি অস্থায়ী কর্মচারী সংগঠনের একটি বড় অংশ শীঘ্রই তৃণমূলে সামিল হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তৃণমূলের দার্জিলিং পাহাড়ের মহিলা সেলের সাধারণ সম্পাদক সারদা ছেত্রী সে কথা খোলাখুলিই বলেছেন। তিনি বলেন, “বহুদিন ধরে পাহাড়ের অস্থায়ী সরকারি কর্মচারিরা নানা বঞ্চনার শিকার। সম্প্রতি তাঁদের একাংশ উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁরা পাহাড়ে রাজ্য সরকার যে ধরনের উন্নয়নের কাজ করছে, তা দেখে আশায় বুক বেঁধেছেন। অনেকেই তৃণমূলে যোগ দিতে চাইছেন।” তিনি জানান, নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাহাড়ে আসার কথা। তখন তাঁর কাছে অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ী করার অনুরোধ করবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। জনমুক্তি অস্থায়ী কর্মচারি সংগঠনের মুখপাত্র দীপক শর্মার বিষয়টি নিয়ে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “যদি সংগঠন ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা সত্যিই ঘটে, তখন যা বলার বলব।”
এদিকে, এ দিন মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি কলকাতা হাইকোর্টে হলফনামা জমা দিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশ না মানার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা চালু হয়েছিল। হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল, মোর্চাকে স্বাভাবিক জনজীবন সচল রাখতে হবে এবং বন্ধ করা চলবে না। এ দিন, হলফনামায় রোশন জানিয়েছেন, হাইকোর্টের নির্দেশের পরে পাহাড়ে কোনও ভাঙচুর হয়নি, অশান্তি হয়নি। উত্তরবঙ্গ পরিবহণ নিগমের বাসও চলেছে। পর্যটকেরাও এসেছেন বলে হলফনামায় জানানো হয়েছে। তাই, আদালত অবমাননা করা হয়নি বলে রোশনের দাবি। তিনি বলেন, “সবে হলফনামা পেশ করেছি। কলকাতা হাইকোর্টে তা নিয়ে শুনানি হোক। তার পরেই হলফনামায় কী রয়েছে বিশদে বলব।” |